তাহারাত ও নাজাসাতের পরিচয় ও গুরুত্ব
তাহারাত ও নাজাসাতের পরিচয় ও গুরুত্ব
তাহারাত বা পবিত্রতার পরিচয় ও গুরুত্ব তাহারাত শব্দটি আরবী, এর আভিধানিক অর্থ পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা। পরিভাষায় নির্ধারিত পন্থায় অপবিত্রতা দূর করা। অর্থাৎ শরীরের বিশেষ অঙ্গসমূহ শরীয়াত নির্ধারিত বিশেষ পদ্ধতিতে ধৌত করাকে তাহারাত বা পবিত্রতা বলে যার মাধ্যমে সালাত আদায় করা সহীহ হয় । ইসলামে তাহারাতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্রতা ছাড়া কোনো ইবাদত কবুল হয় না। ওযু, গোসল ও তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা যায় ৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসেহ্ করবে এবং পা গোড়ালিসহ ধৌত করবে, যদি তোমরা অপবিত্র থাক তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। তোমরা যদি অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ শৌচস্থান হতে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গত হও এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করবে এবং তা দ্বারা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ্ করবে। আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান ও তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।' (মায়িদা, ৫ : ৬) পবিত্র থাকলে শরীর সুস্থ থাকে, মন প্রফুল্ল থাকে, কাজে মন বসে ও তৃপ্তি আসে । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ব্যক্তিকে ভালোবাসেন উল্লেখ করে বলেন- ‘সেখানে এমন লোক আছে যারা পবিত্রতা অর্জন ভালোবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন।' (তওবা, ৯ : ১০৮) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন । তিনি তাঁর উম্মতকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন এবং পবিত্র থাকার জন্য বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন- ‘পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।' (মুসলিম : ৩২৮, বায়হাকী : ২৫৯৫) তাহারাতের উপকারিতা ও ফযীলত তাহারাতের উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘যখন কোনো মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা ওযু করে আর সে তার মুখ ধোয় তখন ওযুর পানি অথবা ওযুর পানির শেষ ফোঁটার সাথে সাথে তার চেহারা থেকে সব গুনাহ বের হয়ে যায়, যা সে তার দুচোখ দিয়ে করেছিল। যখন সে তার দুহাত ধোয় তখন ওযুর পানি অথবা ওযুর পানির শেষ ফোঁটার সাথে সাথে তার উভয় হাত থেকে সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, যা সে হাত দিয়ে করেছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার গুনাহ থেকে পাক হয়ে যায়।' (তিরমিযি :২)
নাজাসাত ও এর প্রকারভেদ
নাজাসাত' অর্থ অপবিত্রতা বা পবিত্রতার বিপরীত। মানুষ বা জীব-জন্তুর শরীর থেকে যে ময়লা বা নাপাক বস্তু বের হলে বা শরীরের কোথাও লাগলে বা এমন অবস্থা যাতে সালাত আদায় করা অবৈধ হয়ে যায় একে শরীয়াতের পরিভাষায় ‘নাজাসাত' বলা হয়। নাজাসাত দুই প্রকার: নাজাসাতে হাকীকী ও নাজাসাতে হুকমী । নাজাসাতে হাকীকী : নাপাকীর এমন এক অবস্থা যা দেখা যায় এবং যা সাধারণত মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করে এবং সে সব নাপাকী থেকে মানুষ নিজের শরীর, জামা কাপড় ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রকে রক্ষা করতে চায়। যেমন মল-মূত্র, রক্ত, মদ ইত্যাদি। নাজাসাতে হাকীকী আবার দুই প্রকার: নাজাসাতে গালীযা ও নাজাসাতে খফীফা। নাজাসাতে হুকমী : নাপাকীর এমন এক অবস্থা যা দৃশ্যমান নয়। বরং শরীয়াতের মাধ্যমে তা জানা যায়। যেমন : ওযুহীন অবস্থায় থাকা, গোসলের প্রয়োজন হওয়া । নাজাসাতে গালীযা : মানুষের মল-মূত্র, রক্ত, বমি, পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে নির্গত যে কোনো তরল বস্তু । নাজাসাতে খফীফা : নাজাসাতে খফীফা নাজাসাতে গালীযার তুলনায় হালকা ও লঘু। যেমন গরু মহিষ হালাল পশুর পেশাব, কাক, চিল বা হারাম পাখির মল, হালাল পাখির মল যদি তা দুর্গন্ধযুক্ত হয়। পানির প্রকারভেদ ও এর হুকুম পানি স্বভাবত পবিত্র। কুরআন কারীমে এরশাদ হয়েছে- ‘আমি আকাশ থেকে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি'। (ফুরকান, ২৫ : ৪৮) তাই যতক্ষণ পর্যন্ত পানি নাপাক হওয়ার প্রমাণ না পাওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা পবিত্র বলে গণ্য হবে। পবিত্রতা অর্জনের দিক থেকে পানি পাঁচ প্রকার: ১. তাহির মুতাহহির: এমন পানি যা নিজে পাক ও অন্য বস্তুকেও পাক পবিত্র করে। যেমন বৃষ্টি, নদী, সমূদ্র, টিউবওয়েল প্রভৃতির পানি। ২. তাহির মুতাহহির মাকরূহ: এমন পানি যা নিজে পাক ও অন্য বস্তুকেও পাক করে তবে তার দ্বারা ওযু ও গোলস করা মাকরূহ। যেমন বিড়াল বা এমন প্রাণী পানিতে মুখ লাগিয়েছে যার উচ্ছিষ্ট মাকরূহ । ৩. তাহির গায়রে মুতাহহির: এমন পানি যা নিজে পাক কিন্তু অন্য বস্তুকে পাক পবিত্র করতে পারে না। যেমন ব্যবহৃত পানি । ৪. নাপাক পানি। যেমন : প্রবহমান পানিতে নাপাকী পড়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করলো যে, পানির রঙ, গন্ধ এবং স্বাদ অথবা যে কোনো একটি গুণ বদলে দিয়েছে অথবা এ ধরনের আবদ্ধ পানি । ৫. মাশকূক পানি: এমন পানি যা দিয়ে ওযু গোসল জায়িয হওয়া বা না হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ থাকে। যেমন : যে পানিতে গাধা বা খচ্চর মুখ দিয়েছে, সে পানির হুকুম হলো এ পানি দিয়ে ওযু করার পর তায়াম্মুমও করতে হবে।
ইসতিনজার নিয়ম
পেশাব-পায়খানার পর পবিত্রতা অর্জনকে ‘ইসতিনজা' বলা হয়। শরীয়াতে ইনতিনজার উপর বিশেষ তাকীদ প্রদান করা হয়েছে। ইসতিনজায় অবহেলা করাকে বড় গুনাহ এবং কবরে আযাবের কারণ বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে- ‘হযরত ইবন আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় বললেন, এ দুজন মুর্দার উপর আযাব হচ্ছে কোনো কঠিন কারণের জন্য নয়। এদের মধ্যে একজন পেশাবের পর ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করতো না এবং অপর একজন চুগলখোরী করে বেড়াতো।' (বুখারী : ২১১)
ওযুর ফরযসমূহ
ওযুর ফরয চারটি: ১. মুখমণ্ডল একবার ধোয়া, ২. উভয় হাত কনুইসহ একবার ধোয়া, ৩. মাথা কমপক্ষে এক চতুর্থাংশ একবার মাসেহ করা এবং ৪. উভয় পা গ্রন্থিসহ একবার ধোয়া। কোন কোন ইমাম কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া ফরয বলে মনে করেন । ওযুর সুন্নতসমূহ ১. ওযুর নিয়ত করা, ২. বিসমিল্লাহ পড়ে ওযু আরম্ভ করা, ৩. উভয় হাত পৃথকভাবে কব্জিসহ তিনবার ধোয়া, ৪. মিসওয়াক করা। ৫. তিনবার কুলি করা, ৬. তিনবার নাকে পানি দেওয়া এবং নাক সাফ করা, ৭. প্রত্যেক অঙ্গকে পূর্ণভাবে তিনবার করে ধোয়া, ৮. দুই হাতে মুখ ধোয়া এবং মুখমণ্ডল ধোয়ার সময় দাড়ি খিলাল করা, ৯. হাত ও পা ধোয়ার সময় আঙ্গুলসমূহ খিলাল করা, ১০. একবার সম্পূর্ণ মাথা মাসেহ করা, ১১. উভয় কান মাসেহ করা, ১২. ওযুর অঙ্গসমূহ হাত দ্বারা ঘষে-মেজে ধোয়া, ১৩. এক অঙ্গ ধোয়ার পর অন্য অঙ্গ ধৌত করতে বিলম্ব না করা, ১৪. তরতীবের সাথে ওযু করা এবং ১৫. ডান দিকের অঙ্গ আগে ধোয়া ।
ওযু ভঙ্গের কারণসমূহ
১. পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু বের হলে, ২. শরীরের যে কোনো স্থান হতে রক্ত, পুঁজ বের হয়ে গড়িয়ে গেলে, ৩. বমির সাথে রক্ত, পুঁজ, খাদ্য বের হলে, ৪. থুথুর সাথে রক্ত এলে এবং রক্তের পরিমাণ বেশি বা সমান হলে, ৫. চিত হয়ে, কাত হয়ে অথবা ঠেস দিয়ে ঘুমালে, ৬. বেহুঁশ, পাগল অথবা নেশাগ্রস্ত হলে, ৭. সালাতে অট্টহাসি দিলে প্রভৃতি । ওযুর মাকরূহসমূহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় করা। প্রয়োজনের চেয়ে কম পরিমাণ পানি ব্যয় করা। চেহারার উপর এমন জোরে পানি নিক্ষেপ করা যে, পানির ছিটা অন্যত্র গিয়ে পড়ে। ওযুর সময় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা ।
গোসল
গোসল আরবী শব্দ, অর্থ সমস্ত শরীর ধোয়া। শরীয়াতের পরিভাষায় পবিত্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র পানি দ্বারা সমস্ত শরীর ধোয়াকে গোসল বলা হয় । সুন্নত গোসল: জুমার সালাত, দুই ঈদের সালাত, হজ বা উমরার ইহরামের পূর্বে এবং হাজীদের জন্য আরাফার দিনে দুপুরের পর গোসল করা সুন্নত । গোসলের আহকাম গোসলের ফরয: গোসলের ফরয তিনটি: ১. কুলি করা, ২. নাকে পানি দেওয়া এবং ৩. সমস্ত শরীর পানি দিয়ে এমনিভাবে ধৌত করা যেন চুল পরিমাণও কোনো স্থান শুকনা না থাকে । গোসলের সুন্নত: গোসলের সুন্নত কাজসমূহ: ‘বিসমিল্লাহ” বলে শুরু করা, গোসলের নিয়ত করা, উভয় হাত কবজি পর্যন্ত ধোয়া, শরীর থেকে নাপাক দূর করা, লজ্জাস্থান ধোয়া, ওযু করা, সারা শরীরে তিনবার পানি দিয়ে ধোয়া এবং মিসওয়াক করা । গোসল ফরয হওয়ার কারণসমূহ ১. সহবাসের পর পুরুষ ও মহিলা উভয়ের গোসল করা অত্যাবশ্যক। ২. সহবাস ব্যতীত যেকোনভাবে কামভাবসহ বীর্য বের হলে । ৩. হায়িয ও নিফাস বন্ধ হলে।
হায়িয ও নিফাস
বালিগ হওয়ার পর স্বভাবগতভাবে মহিলাদের জরায়ু থেকে রোগব্যাধির কারণ ব্যতিরেকে যে রক্ত নির্গত হয়, একে শরীয়াতের পরিভাষায় হায়িয বলে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘লোকেরা আপনাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন, তা অশুচি। সুতরাং তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম বর্জন করবে এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গম করবে না। অতঃপর যখন তারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হবে তখন তাদের নিকট ঠিক সেভাবে গমন করবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালোবাসেন।' (বাকারা, ২ : ২২২) হায়িয হওয়ার বয়স কমপক্ষে নয় বছর। সাধারণত পঞ্চান্ন বছর পর্যন্ত মহিলাদের হায়িয হয়ে থাকে। পঞ্চান্ন বছরের পর রক্তস্রাব হলে একে হায়িয বলে গণ্য করা হবে না। তবে এ বয়সে রক্তের রঙ যদি গাঢ় লাল হয় অথবা কালচে লাল হয় তাহলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে। হায়িযের সময়কাল কমপক্ষে তিন দিন তিন রাত এবং ঊর্ধ্বে দশ দিন দশ রাত। এর বেশি বা কম হলে রক্তস্রাব হলে তা হায়িয বলে গণ্য হবে না । একে বলা হবে ‘ইস্তিহাযা’, যা রোগের কারণে হয়ে থাকে। এর হুকুম হায়িযের হুকুম থেকে ভিন্নতর। কোনো কোনো ইমামের নিকট ১ দিন এবং সর্বোচ্চ ১৫ দিন। হায়িযের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে একেবারে সাদা রঙ ব্যতীত যে রঙের রক্তই আসবে তা লাল, হলুদ, সবুজ, কালো, ধূসর যাই হোক না কেন সবই হায়িয হলে গণ্য হবে ।
হায়িযের মাসাইল
যদি কোনো মেয়ের তিন চার দিন রক্ত আসার অভ্যাস থাকে । তারপর কোনো মাসে তার অধিক দিন এলো, তাহলে তা হায়িয হবে। যদি দশ দিনের বেশি সময় রক্ত আসে তাহলে যতদিনের অভ্যাস ছিল ততদিন হায়িয বলে গণ্য হবে এবং বাকি অংশ ‘ইস্তিহাযা’। দুই হায়িযের মধ্যে পবিত্র অবস্থার সময় কমপক্ষে পনের দিন। বেশির কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই ৷ কোনো মহিলার হায়িযের সময়কালের কম সময় অর্থাৎ দুই একদিন রক্ত আসার পর পনের দিন সে পবিত্র থাকলো। তারপর আবার দুই একদিন রক্ত এলো। এ পনের দিন সে পবিত্র থাকবে। তারপর যে রক্ত আসবে তা হবে ‘ইস্তিহাযা’ । যদি কোনো মহিলার অভ্যাস নির্দিষ্ট না থাকে কখনো চার দিন, কখনো সাত দিন, কখনো দশ দিন স্রাব হয় তাহলে এসব হায়িয বলে গণ্য হবে। তার যদি দশ দিনের বেশি রক্ত আসে, তাহলে দেখতে হবে গত মাসে কত দিন এসেছিল, ততদিন হায়িয ধরা হবে। আর বাকি ইস্তিহাযা।
নিফাস
সন্তান প্রসবের পর স্ত্রীলোকের জরায়ু থেকে যে রক্ত বের হয় তাকে ‘নিফাস' বলে। নিফাসের সময় ঊর্ধ্বে চল্লিশ দিন। আর কমের নির্দিষ্ট সীমা নেই। সন্তান প্রসবের পর যদি কোনো স্ত্রীলোকের রক্তস্রাব না হয় তবুও তার গোসল করা ফরয।
হায়িয ও নিফাসের আহকাম
হায়িয ও নিফাসের দিনগুলোতে সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ । তার কাযাও আদায় করতে হবে না। হায়িযের দিনগুলোতে রোযা নিষিদ্ধ। অবশ্য পরে রোযা কাযা করতে হবে। নফল রোযা রাখা অবস্থায়ও হায়িয শুরু হলে পরে এর কাযা করা জরুরি। হায়িয ও নিফাসের সময় মসজিদে প্রবেশ, কাবা ঘরের তাওয়াক ও কুরআন তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ। তবে যদি এক আয়াত থেকে কম হয় এবং কিরায়াতের নিয়ত না থাকে তাহলে পড়া যাবে, যেমন শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে বা খাওয়ার সময় পড়াতে কোনো দোষ নেই । এ সময় কুরআন স্পর্শ করাও জাযিব নয়, তবে কোনো পবিত্র কাপড়ের সাহায্যে কুরআন স্পর্শ করা যায়। কোনো বস্তু বা স্থানে কুরআনের পূর্ণ এক আয়াত লিখা থাকলে তাও স্পর্শ করা জায়িয নয়, তবে কুরআন দেখা নিষিদ্ধ নয়, এ সময় সহবাস হারাম হলেও একসাথে খাওয়া, এক বিছানায় শোয়া জায়িয আছে। হায়িয ও নিফাসের রক্ত বন্ধ হলে গোসল করা ফরয।
তায়াম্মুম
তায়াম্মুম' এর অভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় ‘তায়াম্মুম' বলা হয় পবিত্র মাটি দ্বারা নাপাকি হতে পাক হওয়ার নিয়াতে মুখমণ্ডল ও উভয় হাত মাসেহ করা । তায়াম্মুম ওযু ও গোসল উভয়ের পরিবর্তে করা যায়। তায়াম্মুমের এ অনুমতি উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ দান ৷ বস্তুত তাহারাত হাসিল করার আসল মাধ্যম হলো পানি, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করে রেখেছেন। তথাপি এমন অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে যে, কোনো স্থানে পানি পাওয়া যাচ্ছে না অথবা পাওয়া গেলেও পানি দিয়ে তাহারাত হাসিল করা কারো সাধ্যের বাইরে অথবা পানি ব্যবহারে রোগবৃদ্ধি অথবা প্রাণের আশঙ্কা রয়েছে। এসব অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা মাটি দিয়ে তাহারাত হাসিল করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তার পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন, যাতে করে বান্দা দীনের উপর আমল করতে কোনো ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন না হয়। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এরশাদ করেন- ‘আর তোমরা যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম করবে এবং তা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কষ্ট দিতে চান না বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান ও তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।' (মায়িদা, ৫ : ৬) যে যে অবস্থায় তায়াম্মুম করা যায় অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য যদি পানি না পাওয়া যায় অথবা পানি ব্যবহারে অপারগ হয় তবে তায়াম্মুম করা জায়িয। অপারগতার ব্যাখ্যা এই যে, পানি আছে কিন্তু ব্যবহারে রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে অথবা স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। অথবা পানি আছে তার পার্শ্বে শত্রু অথবা হিংস্র প্রাণী আছে, সফরে পানি সঙ্গে আছে; কিন্তু সামনে কোথাও পানি পাওয়া না যেতে পারে অথবা ওযু বা গোসল করলে এমন সালাত চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে যার কাযা নেই। পানি কেনার সামর্থ্য অথবা কিনলে সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব অবস্থায় তায়াম্মুম করা জায়েয। তায়াম্মুমের ফরয তায়াম্মুমের ফরয ৩টি : ১. পবিত্রতা অর্জনের নিয়ত করা। ২. উভয় হাত পবিত্র মাটিতে মেরে তা দিয়ে মুখমণ্ডল মাসেহ করা এবং ৩. উভয় হাত পাক মাটিতে মেরে তা দিয়ে উভয় হাত মাসেহ করা । তায়াম্মুমের সুন্নত ১. তায়াম্মুমের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ' বলা । ২. হাত মাটিতে মারার পর মাটি ঝেড়ে ফেলা । ৩. হাত মাটিতে মারার পর আঙ্গুলগুলো ফাঁক ফাঁক করে রাখা । ৪. তারতীব অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল, তারপর উভয় হাত মাসেহ করা। ৫. বিরতিহীনভাবে তায়াম্মুম করা অর্থাৎ উভয় মাসহের মধ্যে বিলম্ব না করা । তায়াম্মুমের মুস্তাহাব যে ব্যক্তির প্রবল ধারণা যে, শেষ সময়ে পানি পাওয়া যাবে, এমন ব্যক্তির জন্য শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি পানি পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তা হলে তায়াম্মুম করে মুস্তাহাব ওয়াক্তে সালাত আদায় করতে হবে।
তায়াম্মুমের পদ্ধতি
প্রথমে নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ' পড়ে তায়াম্মুম শুরু করবে। তারপর দুহাতের তালু একটু প্রসারিত করে পাক মাটির উপর মেরে সামনের দিকে অগ্রসর করবে। তারপর পিছনের দিকে টেনে আনবে। বেশি ধূলাবালি হাতে লেগে গেলে ঝেড়ে নিয়ে অথবা ফুঁক দিয়ে তা ফেলে দিবে। তারপর উভয় হাত দিয়ে সম্পূর্ন মুখমণ্ডল মাসেহ করবে। দ্বিতীয়বার এভাবে মাটির উপর হাত মেরে এবং হাত ঝেড়ে নিয়ে প্রথমে বাম হাতের তিন আঙ্গুলের মাথার নিম্নভাগ দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলের পিঠের দিক থেকে শুরু করে কনুইসহ মাসেহ করবে। তারপর বাম হাতের তালুসহ বৃদ্ধাঙ্গুলি ও শাহাদত আঙ্গুলি দ্বারা ডান হাতের ভিতরের অংশ মাসেহ করবে এবং আঙ্গুলগুলোর খিলালও করবে। পরে এভাবে ডান হাত দিয়ে বাম হাত মাসেহ করবে। হাতে কোনো ঘড়ি বা আংটি থাকলে তা সরিয়ে তার নিচেও মাসেহ করা জরুরি।
তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণসমূহ
যেসব কারণে ওযু নষ্ট হয় সেসব কারণে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়। যে সব কারণে গোসল ওয়াজিব হয়, সে সব কারণে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যায়। যদি পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করা হয়ে থাকে, তাহলে পানি পাওয়ার সাথে সাথে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে। কোনো উযর অথবা রোগের কারণে যদি তায়াম্মুম করা হয়ে থাকে, সে উযর বা রোগ দূর হয়ে গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যায়। মোজার উপর মাসেহ ওযু করে মোজা পরার পর ওযু ভঙ্গ হলে পুনরায় ওযুর সময় পা না ধুয়ে মোজার ওপর মাসেহ করা জায়িয আছে। তবে মোজা খুলে পা ধুয়ে নেওয়া উত্তম । সফরে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত আর সফর ব্যতীত মুকীমের জন্য এক দিন এক রাত পর্যন্ত মোজার ওপর মাসেহ করা জায়িয আছে। যে ওযু করে মোজা পরেছে, তারপর এক দিন এক রাত বা তিন দিন তিন রাতের হিসাব ধরা হবে। গোসলের প্রয়োজন হলে মোজা খুলে ফেলতে হবে, মাসেহ চলবে না। পায়ের পিঠে মোজার ওপর মাসেহ করবে, পায়ের তলায় নয় । মাসেহ করার পদ্ধতি মোজার ওপর মাসেহ করার সময় হাতের আঙ্গুলসমূহ ভিজিয়ে পায়ের উপরের সামনের দিকে আঙ্গুলের উপর যেন মোজার উপর আঙ্গুলগুলোর চাপ পড়ে। তারপর ক্রমশ আঙ্গুলগুলো টেনে পায়ের গিঁটের উপর পর্যন্ত নিয়ে আসবে। অন্য কোনোভাবে মাসেহ করলেও তা জায়িয আছে। তবে তা মুস্তাহাবের খিলাফ ।
পরিশেষে
যে যে কারণে ওযু ভঙ্গ হয় সেসব কারণে মাসেহও ভঙ্গ হবে। সুতরাং উপযুক্ত সময়ের মধ্যে ওযুর সঙ্গে সঙ্গে মোজার উপরও মাসেহ করবে। মোজা খুললেও মাসেহ ভঙ্গ হয়। তাই কারো ওযু ভঙ্গ না হওয়া সত্ত্বেও একটি মোজা খুলে ফেললেও মাসেহ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তখন শুধু পা ধুয়ে নিবে, পুরো ওযু করতে হবে না। মাসেহের সময় পূর্ণ হলে মাসেহ ভঙ্গ হয়ে যায়। ওযু ভঙ্গ না হলেও তখন মোজা খুলে উভয় পা ধুয়ে নিবে ।