তোষামোদ গীবত অপবাদের শাস্তি I Tosamod Givod Opobader Sasti

তোষামোদ গীবত অপবাদের শাস্তি

তোষামোদ হল কিসু ব্যক্তি বা কোনো কাজের সত্ত্বে আহ্বান বা সমর্থন করতে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কথা বা কাজ একটা আহ্বান বা সমর্থন না করে তার বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লিখা হল তা হল তোষামোদ। কারণ ইসলামে সব ব্যক্তির অধিকার আছে তাদের নিজেদের মত কিছু করার এবং না করার। অন্যদের কাজ বা কথা নিয়ে তোষামোদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলামে এটি অপবাদের প্রকার হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গীবত হল কেউ বা কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে মন্দ কথা বলা বা লিখা যা তার অপমানের কারণ হয়। ইসলামে গীবত করা অত্যন্ত ঘৃণিত এবং নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। গীবত করা মানবতার বিপথে চলার একটি উপায় হিসাবে পরিবর্তন হতে পারে এবং গীবতের কারণে ব্যক্তির সম্মান এবং সামাজিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।ইসলামে গীবত করা নিষিদ্ধ হওয়ায় গীবতের জন্য শাস্তি হয়।

তোষামোদ গীবত অপবাদের শাস্তি

তোষামোদ বা অতিশয় প্রশংসা

তোষামোদ ও কারো প্রশংসায় অতিশয় উক্তি করা বা বাড়িয়ে বলা নীচতা ও লজ্জাহীনতার পরিচায়ক। তবে প্রয়োজনে কারো যথাযথ প্রশংসা করা নিন্দনীয় নয় কিন্তু তা ঐ ব্যক্তির সামনে করা উচিত নয়। তোষামোদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা কখনো সঠিক নাও হতে পারে এতে কারো-না-কারো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অতিশয় প্রশংসা করার কারণে প্রকারান্তে প্রশংসিত ব্যক্তিরই ক্ষতি হয়ে থাকে । মাত্রারিক্ত প্রশংসার ফলে তার মধ্যে অহংকারবোধ কাজ করে এবং সে অন্যলোকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে, তার জীবনের গতি থেমে যেতে বাধ্য কারণ তখন নিজের দোষ-ত্রুটি তার নযরে পড়বে না এবং কেউ তাকে শুধরিয়েও দিবে না। তোষামোদ ও অতিশয় প্রশংসাপ্রিয় ব্যক্তি সর্বক্ষণ সমস্ত মানুষের পক্ষ হতে এ জাতীয় প্রশংসা শোনার জন্য আরো উদগ্রীব হতে থাকে। পরিণামে সে খারাপ কৃতকর্মের জন্যও প্রশংসিত হতে চায়। এ ধরনের নির্লজ্জ লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা নিজেরা যা করেছে তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যা নিজেরা করেনি এমন কাজের জন্যও প্রশংসিত হতে ভালোবাসে, তারা শাস্তি হতে মুক্তি পাবে- এরূপ কখনো মনে করো না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।' (আলে ইমরান, ৩ : ১৮৮) যারা অন্যের খোশামোদ করে এবং অবাস্তব প্রশংসা করে তারা মূলত গুনাহের কাজে লিপ্ত। এরা প্রশংসিত ব্যক্তির প্রকৃত কল্যাণকামী নয় মূলত তারা দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে থাকে। অর্থাৎ তারা সুবিধা আদায়ের জন্য একজনের নিকট তোষামোদ ও প্রশংসা করে আবার অন্য লোকের কাছে তার বদনাম করে থাকে। এরূপ দ্বিমুখী নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তির শাস্তি সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- 'দুনিয়ার জীবনে যে ব্যক্তি দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করবে কিয়ামতের দিন তার মুখে একটি আগুনের জিহ্বা লাগিয়ে দেওয়া হবে। (দারেমী : ২৮২০ ) এজন্য কারো মুখের উপর প্রশংসা করতে নেই এবং কেউ এ রকম করলে তাকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। মুখের উপর প্রশংসাকারী ব্যক্তি সম্পর্কে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘তোমরা যদি কাউকে মাত্রারিক্ত প্রশংসা করতে দেখ তাহলে তার মুখে মাটি ছুড়ে মারবে।' (মুসলিম : ৫৩২৩, মুসনাদে আহমাদ : ৫৪২৬, বায়হাকী ৪৬৭২, তবারানি : ৩৬৬)

গীবত বা পরনিন্দা করা

গীবত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দোষারোপ করা, পরনিন্দা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে সমালোচনা করা ইত্যাদি। কোনো মানুষের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে মনঃকষ্ট পায়, তাকে গীবত বলা হয়। কারো বিরুদ্ধে গীবত করা অসচ্চরিত্রের একটি মারাত্মক দিক। পরনিন্দা চর্চাকারী ব্যক্তি কখনই ভালো মানুষ হতে পারে না। গীবত সম্পর্কে রাসূল এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন- 'গীবত হলো ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, যদি তার মধ্যে সেই দোষ-ত্রুটি থেকে থাকে? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলেও সেটা হবে গীবত। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে সেটা হবে তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ।' (মুসলিম : ৪৬৯০, আবু দাউদ : ৪২৩১ ) সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলা গীবত যা যে অপছন্দ করে। অবশ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর মনোভাব নিয়ে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আন্তরিকতার সহিত কারো দোষত্রুটি ধরিয়ে দিলে তা গীবত বলে গণ্য হবে না। ইসলাস গীবত হারাম ও কবিরাহ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।' (হুমাজাহ, ১০৬ : ১) গীবত ঘৃণ্য কাজের সাথে তুলনা করে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘তোমরা বেশি ধারণা করা থেকে বিরত থাকো; কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো এটিকে ঘৃণ্যই মনে কর।' (হুজুরাত, ৪৯ : ১২) গীবতের পর ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা মানব চরিত্রের নেতিবাচক দোষ-ত্রুটির মধ্যে অন্যতম। অধিকাংশ লোক গাফিলতি ও উদাসীনতায় নিমজ্জিত থেকে একাজে লিপ্ত হয়। কাউকে হেয় ও অপমান করার জন্য তার চলা-ফেরা, ওঠা-বসা, হাসা, কথা বলা ইত্যাদি ব্যঙ্গচ্ছলে নকল করা বা ইশারা ইঙ্গিতে তার দোষ প্রকাশ করাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ বলে। এসব অনর্থক কাজকর্ম মুসলমানদের মধ্যে মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ লোক থেকে শীর্ষস্থানীয় লোকেরা পর্যন্ত এ ব্যাধিতে আক্রান্ত। এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন- 'পুরুষগণ অন্য পুরষের প্রতি উপহাস করা উচিত নয়, হতে পারে সে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর নারীগণ অন্য নারীগণের প্রতি উপহাস করা উচিত নয়. হতে পারে সে তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।' (হুজুরাত, ৪৯ : ১১)

অপবাদ বা কুৎসা রটানো

অপবাদ এর আরবী এর আভিধানিক অর্থ অপবাদ, বদনাম, কুৎসা রটানো, মিথ্যারোপ করা ইত্যাদি। পরিভাষায় কোনো লোকের মধ্যে যে দোষ নেই তার প্রতি সে দোষ আরোপ করাকে অপবাদ বলা হয়। অপবাদ গীবতের চেয়েও গুরুতর অপরাধ। কেউ কোনো অন্যায় করেনি বা যার মধ্যে যে দোষ নেই সেটা প্রচারের নামই অপবাদ । সমাজবদ্ধ জীবনে নানা কারণে মানুষের ইজ্জত ও সম্ভ্রম হুমকির মুখে পড়ে। এর অন্যতম মাধ্যম অপবাদ। মানুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষায় ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। অপবাদকারী কারো বিরুদ্ধে অপবাদ করেই যাতে পার না পেয়ে যায় তাই তাকে ইসলামের বিধিমালা অনুযায়ী প্রথমেই চারজন সাক্ষী উপস্থিত করাতে হবে। সাক্ষী উপস্থিত করাতে না পারলে তাকেই শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন- 'যারা সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না, এরা তো সত্যত্যাগী।' (নূর, ২৪ : 8 ) ইসলামে অপবাদ সৃষ্টি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে নারীর প্রতি অপবাদের যে কোনো প্রবণতার বিরুদ্ধে ইসলাম কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছে। কেউ যাতে তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনায় সাহসী না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করতে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- 'যারা সাধ্বী, সরলমনা ও ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।' (নূর, ২৪ : ২৩) আর এই অভিশপ্ত অপবাদকারীর শাস্তি কী হবে সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- 'যে দিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের চরণ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে, সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দিবেন এবং তারা জানবে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট প্রকাশক।' (নূর, ২৪ : ২৪-২৫) সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সতীসাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়াকে ধ্বংসকারী বস্তু আখ্যা দিয়ে বলেন- 'তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু থেকে বেঁচে থাক'। তারা বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কি?' তিনি বললেন 'আল্লাহর সাথে শরিক করা, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ হারাম যাদু, করেছেন, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সাধ্বী বিশ্বাসী সরলমনা রমণীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করা।' (বুখারী : ৬৩৫১, মুসলিম : ১২৯, আবু দাউদ : ২৪৯০)

পরিশেষে

এমনকি আপন ক্রীতদাসের বিরুদ্ধে অপবাদ প্রদানকারীকে কিয়ামতের দিন শাস্তি প্রদান করা হবে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ বলেন- কেউ আপন ক্রীতদাসের প্রতি অপবাদ আরোপ করল। অথচ সে (ক্রীতদাস) তা থেকে পবিত্র যা সে বলেছে। কিয়ামত দিবসে তাকে কশাঘাত করা হবে। তবে যদি এমনই হয় সে যা বলেছে তা যথাযথ তাহলে কশাঘাত করা হবে না।'(বুখারী:৬৩৫২)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url