ব্যভিচার ফিতনা ফাসাদ এর ভয়ঙ্কর পরিণতি I Bavichar Fitna Fasad Er voyonkor porinoti

ব্যভিচার ফিতনা ফাসাদ এর পরিণতি

ইসলামে ব্যভিচার একটি দুষ্ট কর্ম হিসাবে বিবেচিত এবং ফিতনা এবং ফাসাদের একটি উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। কুরআনে একটি স্পষ্ট নির্দেশনা আছে যা ব্যভিচার করা বিরোধী এবং এটি একটি অত্যন্ত দুষ্ট কর্ম হিসাবে বর্ণিত হয়। ব্যভিচার একটি নারীকে অবমাননার অভিশাপ দেয় এবং এর ফলে পারিবারিক সম্পর্ক ও সমাজ সংস্কৃতি উদ্ধত হয়। এটি নারীদের মানসিক এবং শারীরিক অসুবিধার কারণ হতে পারে এবং এটি সমাজে বিভিন্ন সমস্যার উৎপাদক হতে পারে। ইসলাম একটি সৎ ও পবিত্র সমাজ গঠনের লক্ষ্য রাখে এবং সমাজের হারাম কর্ম প্রতিরোধ করতে শিক্ষা দেয়।

ব্যভিচার ফিতনা ফাসাদ এর ভয়ঙ্কর পরিণতি

যেনা ব্যভিচার

একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যকার বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে যিনা বা ব্যভিচার। ব্যভিচার একটি মহা অপরাধ, যা অনেক অপরাধের সমষ্টি ধর্মীয়, সামাজিক ও আদর্শিক সব মাপকাঠিতেই এটি জঘন্য অপরাধ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সকল ধর্ম ও সকল দেশেই এটি অন্যায় বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নারীর সতীত্বের হিফাযত ও খিয়ানতের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পবিত্রতা। নারীর গর্ভেই জন্ম নেয় রাজা-রাণী, গবেষক-পণ্ডিত, সমাজ সংস্কার থেকে শুরু করে যুগশ্রেষ্ঠ সকল মনীষী । যিনা-ব্যভিচারকে সামাজিকভাবে খুবই ঘৃণ্য ও অপরাধমূলক কাজ হিসেবে দেখা হয় ৷ ইসলামও এ অপরাধকে সর্বাধিক ঘূর্ণিত বিবেচনা করে । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যিনাকে অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ আখ্যায়িত করে তার নিকটবর্তী না হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে বলেন- 'তোমরা যিনার নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।' (বনী ইসরাঈল, ১৭ : ৩২)

ইসলামের মানবিক অপরাধসমূহের যে সব শাস্তি পবিত্র কুরআনুল কারীমে নির্ধারিত রয়েছে তন্মধ্যে ব্যভিচারের শাস্তি সব চাইতে কঠোর ও গুরুতর। ব্যভিচারকারীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন না করার নির্দেশ দিয়ে কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী-তাদের প্রত্যেককে একশত কষাঘাত করবে, আল্লাহর বিধান কার্যকরে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবাম্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। (নূর, ২৪ : ২) ব্যভিচারের শাস্তিস্বরূপ ব্যভিচারী পুরুষ ব্যভিচারিণী বা মুশরিকা মহিলা ছাড়া এবং ব্যভিচারী মহিলা ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো মুমিন ব্যক্তিকে বিবাহ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালার ভাষায়- ‘ব্যভিচারী ব্যভিচারিণীকে অথবা মুশরিক নারীকে ব্যতীত বিবাহ করে না এবং ব্যভিচারিণী- তাকে ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ব্যতীত কেউ বিবাহ করে না, মুমিনদের জন্য এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।' (নূর, ২৪ : ৩)

ব্যভিচার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনেক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ব্যভিচারকে কিয়ামতের আলামত উল্লেখ করে তিনি বলেন- 'কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর মধ্যে কয়েকটি এই— জ্ঞান উঠিয়ে নেওয়া হবে, মূর্খতা জেঁকে বসবে, মদপান করা হবে এবং ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে।' (বুখারী : ৭৮, মুসলিম : ৪৮২৪, নাসাঈ : ৫৯০৫) ব্যভিচারে লিপ্ত থাকাকালে ব্যভিচারী ব্যক্তির ঈমান না থাকা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না।' (বুখারী ৬২৮৪, মুসলিম : ৮৬, আবু দাউদ : ৪০৬৯, তিরমিযি : ২৫৪৯)

অবৈধভাবে যৌনাঙ্গের মাধ্যমে যৌন স্বাদ আস্বাদন গ্রহণ করা যেমনিভাবে ব্যভিচার তেমনিভাবে চোখ ও জিহ্বাসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমেও যৌন স্বাদ আস্বাদন করাও ব্যভিচার উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা আদম সন্তানের জন্য যিনার একটি অংশ লিখে দিয়েছেন যা সে অনিবার্যরূপে করে থাকে। সুতরাং চোখের যিনা হলো দর্শন এবং মুখের যিনা হলো বাক্যালাপ। অতঃপর মন আকাঙ্ক্ষা করে এবং যৌনাঙ্গ তা সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।' (বুখারী : ৫৭৭৪, মুসলিম : ৪৮০১ ) অনিবার্যরূপে বান্দা যে ব্যভিচার করে থাকে তা হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতি তথা ডিশ ও ইন্টারনেটের বদৌলতে প্রাপ্ত পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল প্রভৃতির স্বাদ আস্বাদন। আধুনিক পার্টি-অনুষ্ঠানের নামে অশ্লীল হোলি, পিকনিক, ককটেল পার্টি, যাত্রা প্রভৃতি অনুষ্ঠান উদযাপনে অংশগ্রহণ। এ ধরনের অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে এবং তা না ছড়াতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপনে হোক অশ্লীল কাজের নিকটেও যাবে না।' (আনআম, ৬ : ১৫১)

সামাজিক আচার আচরণে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বিয়ের অনুষ্ঠানাদিতে উদোম-খোলামেলা চলাফেরা ক্রমান্বয়ে ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে বলে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘মুমিন পুরুষদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, আর এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, তারা যেন যা সাধারণত অনাবৃত থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে, তাদের গলা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।' (নূর, ২৪ : 30-31 ) অনাগত প্রজন্ম যেন একটি সুরক্ষিত পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে সে জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। বিয়েবহির্ভূত সন্তানরা পৃথিবীতে পা রাখে পিতৃপরিচয়হীন ঘৃণার পাত্র হয়ে। সুতরাং ভারসাম্যপূর্ণ একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যেই সকল প্রকার যিনা-ব্যভিচার ও অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব ।

ফিতনা-ফাসাদ

ফিতনা ও ফাসাদ এর আভিধানিক অর্থ গোলযোগ, দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা, বিশৃংখলা, কলহ, নির্যাতন ইত্যাদি। পরিভাষায়, ফিতনা-ফাসাদ বলতে বিশৃংখলা-বিপর্যয় সৃষ্টি বুঝায় । সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার বিপরীত অরাজক পরিস্থিতিই ফিতনা- ফাসাদ। মানবসমাজে ভয়-ভীতি, অত্যাচার-অনাচার ইত্যাদির মাধ্যমে নানা বিপর্যয় সৃষ্টি করাই ফিতনা-ফাসাদ। সন্ত্রাস, ছিনতাই, রাহাজানি, গুম, খুন, অপহরণ, জঙ্গিবাদ, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, কলহ, ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ- বিগ্রহ ইত্যাদি ফিতনা-ফাসাদের অন্তর্ভুক্ত। ফিতনা-ফাসাদ অত্যন্ত মারাত্মক অপরাধ। এর দ্বারা সমাজে সকল অন্যায় অত্যাচারের দরজা খুলে যায়। অরাজক পরিস্থিতিতে অসৎ মানুষেরা সব ধরনের পাপ কাজের সুযোগ পায়। ফিতনার অপরাধ গুরুতর যে তা হত্যার চেয়েও জঘন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।' (বাকারা, ২ : ১৯১)

ফিতনা-ফাসাদ ইসলামী আদর্শ বিরোধী। এটি হারাম তথা নিষিদ্ধ । আল্লাহ তায়ালা বিশৃংখলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করে বলেন- 'দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা সেখানে বিপর্যয় ঘটিও না, তাঁকে (প্রতিপালককে) ভয় ও আশার সঙ্গে ডাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।' (আরাফ, ৭:৫৬ ) পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষ তার অন্যায় ও মন্দকর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে নানা ধরনের ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। যারা ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি করে তারা খুবই জঘন্য চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তায়ালাও তাদের পছন্দ করেন না। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- ‘তুমি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।' (কাসাস, ২৮ : ৭৭)

ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টিকারিদের শাস্তির বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।' (মায়িদা, ৫ : ৩৩)

পরিশেষে

ইসলাম শান্তির ধর্ম, সুশৃংখল ও সুন্দর জীবন ব্যবস্থা। এতে বিশৃংখলা ও অরাজকতার স্থান নেই । বরং ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী, উদারতা, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি ইসলামের মূল ভিত্তি। ইসলামের সকল আচার- আচরণ, বিধি-বিধান বিজ্ঞানসম্মত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url