মাদক গ্রহনের ভয়াবহ পরিনতি।

মাদক গ্রহনের পরিনতি

মাদক গ্রহন মানব সমাজের জন্য একটি অত্যন্ত ভয়াবহ সমস্যা। মাদক গ্রহণের পরিণতি অনেকগুলি রয়েছে, যা একজন মাদক গ্রাসকে নিজেকে ও তার পরিবারকে ভঙ্গিত করতে পারে। একজন মাদক গ্রহনকারীনিজেকে নির্বোধ করে তুলে ধরতে পারে এবং তার সমাজে আরও দুর্বলতা এবং উপসর্গ করতে পারে। ইসলামে মাদক গ্রহনের ভয়াবহ পরিণতি বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কোরআন এবং হাদিসে। ইসলাম মাদক গ্রহণ ও বিক্রয়কে একটি অত্যন্ত নিষেধাজ্ঞা দেয়। কুরআন সমস্ত প্রকার মাদক পরিহিত করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এটি দ্রুত মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি উল্লেখ করেছে।

 মাদক গ্রহনের ভয়াবহ পরিনতি।

মাদক নেশা ও ক্ষতিকর দ্রব্য

মদ বা মাদকদ্রব্যের এর আভিধানিক অর্থ সমাচ্ছন্ন করা, ঢেকে দেওয়া, নেশাচ্ছন্ন করা ইত্যাদি। পরিভাষায় যে সকল বস্তু সেবনে মাদকতা সৃষ্টি হয় এবং বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে মাদকতা বলা হয় । মূলত যেসব প্রাকৃতিক, রাসায়নিক দ্রব্য বা উপাদান গ্রহণ করলে স্নায়ুবিক উত্তেজনা, কিছুটা সাময়িক মানসিক প্রশান্তি ও আনন্দ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় তাকেই মাদকদ্রব্য বলে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ফেনসিডিল, হাশিশ, আফিম, গাঁজা, বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, হুকা, হিরোইন, প্যাথেডিন, মরফিন, কোকেন, মেথাডন, হুইস্কি, ভদকা, তাড়ি, স্পিরিট, ইয়াবা ইত্যাদি মাদক দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। এ সকল দ্রব্য মদের মতই নেশাকর ও ক্ষতিকর। মদ ও মাদকদ্রব্য মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তার জ্ঞানকে ঢেকে ফেলে, বোধশক্তির উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং চেতনাকে বিলোপ করে। এর মধ্যে উপকারের চেয়ে অপকার বা পাপ অনেক বেশি পরিমাণে রয়েছে বলে কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- ‘লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।' (বাকারা, ২ : ২১৯) মাদকদ্রব্য ঘৃণ্য বস্তু আর তা সেবন বা গ্রহণ শয়তানের কাজ। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সফলতা অর্জন করতে পারে না, কেননা শয়তান নেশাগ্রস্ত করে মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও সালাত আদায়ে বাধা প্রদান করে । কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাতে বাধা দিতে চায় । তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?' (মায়িদা, ৫ : ৯০-৯১)

মাদক গ্রহণ সকল অপরাধ ও পাপ কাজের উৎস

মাদক গ্রহণ বা সেবন সকল অপরাধ ও পাপ কাজের উৎস। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মাতাল বা স্বাভাবিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় থাকে বলে তার দ্বারা সকল পাপকাজ করা সম্ভবপর বিধায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাতাল ব্যক্তির মৃত্যুকে জাহেলিয়াতের মৃত্যু উল্লেখ করে বলেন- ‘মদ্যপান সকল অশ্লীলতার উৎস। অতঃপর যে ব্যক্তি তা পান করলো পরবর্তী চল্লিশ দিন তার সালাত কবুল হবে না। তা তার পেটে থাকা অবস্থায় যদি সে মারা যায় তাহলে তা হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।' (তবারানি : ১৫৪৩) অপর হাদীসে মাদকাসক্তির পরিণাম উল্লেখ করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেছেন- “যে ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয় বা মাতাল হয় তার চল্লিশ সকালের ইবাদত কবুল হবে না। এমতাবস্থায় যদি সে মারা যায় তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।' (ইবনে মাজাহ : ৩৩৬৮) মুমিন ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় মদপান করতে পারে না। মদ্যপ অবস্থায় তার ঈমান থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘কোনো মদ্যপায়ী মুমিন থাকা অবস্থায় মদ্যপান করতে পারে না। (বুখারী: (২৯৫)

মাদকতা হারাম

ইসলাম শুধু মদপানকেই হারাম করেনি বরং মদকেন্দ্রিক যা কিছু করা হয় বা করার প্রয়োজন হয়, যেমন মদ উৎপাদন, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবেশন ও উপহার প্রদান বা গ্রহণ; সবকিছুকেই সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- ‘যে মহান সত্তা মদপান হারাম করেছেন, তিনি এর ব্যবসাও হারাম করেছেন।' (মুসলিম : ২৯৫৭ )

মদ অভিশপ্ত বস্তু

মদ একটি অভিশপ্ত বস্তু, তার তৈরি, পরিবেশন, বিতরণ, পান ও বহন সকল কাজই অভিশপ্ত। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অভিশপ্ত উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত করেন মদের প্রতি, তার পানকারীর প্রতি, তার পরিবেশনকারীর প্রতি, তার বিক্রেতার প্রতি, তার ক্রেতার প্রতি, তার প্রস্তুতকারীর প্রতি, তার প্রস্তুতের পরামর্শদাতার প্রতি, তার বহনকারীর প্রতি এবং তা যার নিকট বহন করা হয় তার প্রতি।' (আবু দাউদঃ ৩১৮৯, তবারানি : ৭১৩) মাদকাসক্তির ব্যক্তির পরকালে পরিণাম ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'যে ব্যক্তি দুনিয়ায় মাদকদ্রব্য গ্রহণ করবে আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাকে 'তীনাতুল খাবাল' পান করাবেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! 'তীনাতুল খাবাল' কি? তিনি উত্তরে বললেন, এটি হলো জাহান্নামীদের শরীরের ঘাম।' (মুসলিম : ৩৭৩২ ) অনেকেই মনে করেন, অল্প-স্বল্প মাদকদ্রব্য গ্রহণ হয়তো হারাম নয়। যেহেতু কিছু মাদকদ্রব্য আছে যেগুলো পৃথকভাবে অল্প গ্রহণ করলে বা অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে গ্রহণ করলে মত্ততা সৃষ্টি হয় না বা নেশার উদ্রেক ঘটায় না সেহেতু তা গ্রহণ করা দোষের কিছু নয়। এ রকম ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নেশার সৃষ্টি হোক বা না হোক যে বস্তু অধিক পরিমাণ গ্রহণে নেশার সৃষ্টি হয় তার সামান্য গ্রহণ বা সেবন করাও নিষিদ্ধ। রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেছেন- *যে জিনিস অধিক পরিমাণে গ্রহণ করলে নেশার সৃষ্টি করে, তার স্বল্প পরিমাণ গ্রহণ করাও হারাম।' (তিরমিযি : ১৭৮৮)

মাদক সেবন স্বাস্থ্যহানি ঘটে

মাদক সেবন বা গ্রহণে স্বাস্থ্যহানি ঘটে ও কর্মক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। নানা রোগের সৃষ্টি হয়, এর করুণ পরিণতিতে মাদকতাসক্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সাধারণ ব্যক্তিদের তুলনায় মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে দেয়, যা কোনোভাবেই পুনরুদ্ধার সম্ভয় নয়। মাদকদ্রব্যের প্রতিক্রিয়া রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয় ও কিডনিতে প্রদাহের সৃষ্টি করে এসব শরীরের মূল্যবান অংশ অকেজো করে দেয় । অধিকাংশ মাদকসেবী পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হয় । মাদকাসক্তের কারণে পরিবারে ভাঙ্গন ধরে। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হক এর বাণী অনুযায়ী এটি অন্য অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অন্যতম কারণ। মাদক সেবন ইসলামী আইনে একটি ফৌজদারি অপরাধ। এ জন্য শরীয়ত অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া একান্ত কর্তব্য। সমাজের বিভিন্ন অপরাধী মাদকদ্রব্য সেবনের সাথে জড়িত। এ জন্য কোনোভাবেই মাদকের ব্যবহার ও বিস্তার ঘটতে দেওয়া যাবে না।

পরিশেষে বলা যায় যে,

সমাজ, রাষ্ট্র, সচেতন মহল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সকলকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রনে এগিয়ে আসতে হবে। এর ভয়াবহতা, কুফল ও পরিণাম সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সমাজকে মাদকের ভয়ঙ্কর গ্রাস থেকে রক্ষা করুন এবং পরকালের কঠিন শাস্তি হতে মুক্তি দিন। আমীন!

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url