শরীয়ার উৎস ও মূলনীতি

শরীয়ার উৎস ও মূলনীতি

শরীয়া বা ইসলামী শরীয়াত হলো ইসলামী ধর্মের আদর্শগুলোর একটি সমন্বিত সংকলন যা মানব জীবনের সকল বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। শরীয়াত ইসলামী উপদেশের ব্যাপারে মূলতঃ আল-কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত। ইসলামের উৎস হল আল-কুরআন ও হাদিস। আল-কুরআন হল ইসলামী ধর্মের পবিত্র বই যা মুসলিমদের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিপাদ্য হয়। হাদিস হল প্রখ্যাপনকৃত মুসলিম প্রবন্ধ যা নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বক্তব্য ও আচরণ সম্পর্কে বিবরণ করে। হাদিস মূলতঃ মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসাবে গণ্য হয়। শরীয়ার মূলনীতি ইসলামের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির পূর্ণতা এবং অন্যকে সম্মান করা এবং একটি সুসংবাদ মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজ গঠন করা।

শরীয়ার উৎস ও মূলনীতি

ইসলামী আইনের উৎস

ইসলামী আইনের প্রধান মৌলিক উৎস কুরআনুল কারীম এবং দ্বিতীয় মৌলিক উৎস হচ্ছে সুন্নাহ বা হাদীস। ইজমা ও কিয়াসকে শরীয়ার শাখা উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শরীয়ার বিষয়াবলি যে শাস্ত্র দ্বারা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, তাকে বলা হয় ফিকহ। শরীয়াহ বা বিধি-বিধান প্রণয়নের অধিকার একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তারা বলে, দীনের (বিধি প্রণয়নের) ব্যাপারে আমাদের কি কোনো অধিকার আছে? আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই যাবতীয় বিধি-বিধান প্রণয়নের ইখতিয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার।' (আলে ইমরান, ৩:১৫৪)

শরীয়ার সকল বিধি-বিধানের প্রধান দুটি উৎসকে আঁকড়ে ধরার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ বলেন-'আমি তোমাদের জন্য দুটো বিষয় রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটোকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন কিছুতেই বিপথগামী হবে না। সে দুটো হলো : আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।' (মুয়াত্তা মালেক : ১৩৯৫

ইসলামী আইনের মূলনীতি

ইসলামের বিধি-বিধান তথা আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, আচার- ব্যবহার ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ার ভিন্ন ভিন্ন মূলনীতি রয়েছে। ইসলামী আইনবেত্তাগণ শরীয়াহ পরিপালনের সুবিধার্থে রাসূল বর্ণিত ‘তা’বিরে নাখল' সম্পর্কিত হাদীসের ভিত্তিতে শরীয়ার দুটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন। যথাঃ ০১. ইবাদত । ০২. মুয়ামালাত। তা'বিরে নাখল সম্পর্কিত হাদীসটি নিম্নরূপ-'রাফে ইবনে খাদীজ (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) বলেন, একবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )মদীনায় তাশরীফ আনলেন। এ সময় মদীনাবাসী খেজুর গাছে নরকুঁড়ি লাগাচ্ছিলেন। তারা বলেন, তারা স্ত্রী খেজুর গাছে নরের পাপড়ি ঢুকাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী করছ? তারা বললো, আমরা এরূপ কাজ করতাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সম্ভবত তোমরা এরূপ না করলেই ভালো হতো। রাফে বলেন, এরপর তারা একাজ ছেড়ে দিল। এতে ফল ঝরে গেল অথবা কমে গেল। রাফে বলেন, লোকেরা এ খবর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জানালে তিনি বললেন, আমি তো একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদেরকে দীন সম্পর্কে কোনো আদেশ করি তখন তোমরা তা যত্ন সহকারে পালন কর, আর যখন আমার ব্যক্তিগত মতামত দ্বারা কোনো কিছু পরামর্শ দেই, তখন মনে করবে, আমি একজন মানুষ (মানুষ হিসাবে ভুল হওয়া স্বাভাবিক)। ইকরামা বলেন, হাদীসের রাবী সন্দেহ পোষণ করেছেন বলেছেন অথবা এরূপ অন্যকিছু। মা'কেরী নাকি নিশ্চিতভাবে বলেছেন, কোনো সন্দেহ পোষণ করেননি।' (মুসলিম : ৪৩৫৭

ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়ার মূলনীতি

আল্লাহ্ তায়ালার দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জন করে চলার নামই ইবাদত। ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহের মধ্যে কালিমা, সালাত, সাওম, যাকাত, হজ, তাসবীহ, তাহলীল, যিকর- আযকার, আকিদা-বিশ্বাস ও তাহারাত অন্যতম। ইবাদতের যাবতীয় বিধিবিধান সপ্রমাণিত, সুপ্রতিষ্ঠিত, সুস্থির ও অপরিবর্তনীয়। ইবাদাতের কোনো কিছু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নতুনভাবে উদ্ভাবন বা সংযোজন ও বিয়োজন করার অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র কুরআন সুন্নাহকেই দলিল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মৌলিক ইবাদতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা সংযোজন-বিয়োজন করে তা শরীয়ার অন্তর্ভুক্ত মনে করা আল্লাহ তায়ালার উপর কর্তৃত্ব করার শামিল । আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'এদের কি এমন কতকগুলি দেবতা আছে? যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দীনের, খার অনুমতি আল্লাহ দেননি।' (শুরা, ৪২ : ২১) এ সম্পর্কে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- 'যে কেউ এমন কোনো আমল করবে, যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই তবে সেই আমল বাতিল বলে গণ্য হবে।' (মুসলিম : ৩২৪৩ ) ইবাদত বিষয়ে সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) সবসময় কুরআন-সুন্নাহকেই মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উল্লিখিত কুরআন-সুন্নার আলোকে ইসলামী আইনবেত্তাগণ ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি পেশ করেছেন। ইবাদতের মূলনীতি উল্লেখ করে আল্লামা ইউছুফ আল কারযাভি তাঁর গ্রন্থে এ বলেন- ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো নিষিদ্ধতা।’ ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তের সিদ্ধান্ত হলো- শরীয়ত প্রবর্তনকারীর পক্ষ থেকে ইবাদতটির প্রমাণিত হওয়া বাধ্যতামূলক। প্রমাণ ও দলীল ছাড়া আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কোনো বিষয়কে ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না ।

মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে শরীয়ার মূলনীতি

আর্থিক লেনদেন, ক্রয়বিক্রয়, আদান-প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, ক্ষেত-খামার, বিচার-ফায়সালা, সম্পর্ক-সম্বন্ধ, আমানত, মিরাস, হদ, প্রশাসন পরিচালনা প্রভৃতি জাগতিক কর্মকাণ্ড মুয়ামালাতের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে রাসূল এর জীবদ্দশায় মানুষের জন্য যা প্রয়োজন হয়নি কিন্তু পরবর্তীতে মানুষের জীবন-যাপন পরিবর্তনের সাথে সাথে যেসব বিষয় নতুনভাবে প্রয়োজন দেখা দিবে তার সমাধানের জন্য ইসলামী শরীয়াতে সুযোগ রাখা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-,‘যা তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন তা বিশদভাবেই তোমাদের নিকট বিবৃত করেছেন।' (আন'আম, ০৬ : ১১৯) মহান আল্লাহ আরও বলেন- 'তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর।' (তাগাবুন: ১৬) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন-‘আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। তিনি যে বিষয়ে চুপ থেকেছেন তা অনুগ্রহ। অতএব তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গ্রহণ করো।' (মুসতাদরাক : ৩৩৭৬, তবারানি : ২০৬২, দারে কুতনী : ২০৮৯) শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী আনুগত্য ও অনুসরণ বিষয়ে নবী করিম বলেন-‘সুতরাং যখন আমি কোনো বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন কোনো বিষয়ে আদেশ করি, তখন যতক্ষণ তোমাদের শক্তি সামর্থ্য থাকে তা করবে।' (বুখারী : ৬৭৪৪, নাসাঈ : ২৫৭২) অপর আরেকটি হাদীসে এসেছে- সুতরাং আমি যখন কোনো বিষয়ের নির্দেশ দেই, তোমরা যথাসাধ্য তা গ্রহণ করো এবং যে বিষয় থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করি, তা থেকে বিরত থাক।' (ইবনে মাজাহ : ০২, তবারানি : ২৯৮) উল্লিখিত কুরআন-সুন্নার আলোকে ইসলামী আইনবেত্তাগণ মুয়ামালাহ-এর ক্ষেত্রে মূলনীতি পেশ করেছেন। মুয়ামালাতের মূলনীতি উল্লেখ করে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম কহিলারা তাঁর ইলামুল মুওয়াক্কিঈন নামক গ্রন্থে বলেন- জাগতিক বিষয়ে মূলনীতি হচ্ছে বৈধতা।’মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে শরীয়ার মূলনীতি হলো তা বৈধ যতক্ষণ না অবৈধ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন শরীয়ত নিষিদ্ধ করে নাই এমন সব বিষয় বৈধ। অর্থাৎ নিষিদ্ধ হবার কোনো দলীল প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সব বৈধ ও জায়েয । আধুনিক ব্যাংক ও বীমা সংক্রান্ত যাবতীয় লেন-দেন জাগতিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। তাই এক্ষেত্রে মুয়ামালাতের মূলনীতি প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়ত নির্ধারিত কোনো নিষিদ্ধতা পাওয়া না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রকারের যাবতীয় লেন-দেন বৈধ বলে গণ্য হবে । এ মূলনীতির ভিত্তিতে আধুনিক ফক্বীহগণ এমন অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা সরাসরি কুরআন ও সুন্নাতে উল্লেখ নেই। তবে তা কুরআন ও সুন্নার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়

ইসলামী আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্য যে সকল সুবিধা, কল্যাণ বা উপকারিতা শরীয়ার মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন তাই মাকাসিদুশ শরীয়ার অন্তর্ভুক্ত। শরীয়ার উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির জন্য যা ভালো, কল্যাণকর, উপকারী, সুবিধাজনক তা নিশ্চিত করা এবং যা ক্ষতিকর, অকল্যাণকর, কষ্টদায়ক, পীড়াদায়ক প্রভৃতি তা বিদূরিত করা । আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-‘আল্লাহ তোমাদের সাথে সহজ নীতি অবলম্বন করতে চান, কঠোর নীতি অবলম্বন করতে চান না।' (বাকারা, ২ : ১৮৫) পবিত্র হাদীসে এসেছে- আবু মুসা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাহাবীদের কাউকে কোনো কাজে পাঠালে বলে দিতেন, ‘সুসংবাদ দাও, ভীতি প্রদর্শন করো না। সহজ করো, কঠিন করো না।' (মুসলিম : ৩২৬২)

পরিশেষে

শরীয়ার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো, যথাযথ নিয়ম ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করার মাধ্যমে মানুষের জন্য তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করা এবং মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি, সাফল্য ও কল্যাণের পথ প্রদর্শন করা ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url