ইসলামী শরিয়তের পরিচয়

ইসলামী শরিয়তের পরিচয়

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইসলামের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করার পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান প্রদান করেছেন। আদেশ-নিষেধ জারি করেছেন। অনেক বিষয় বৈধ বা হালাল করেছেন, আবার কিছু কিছু বিষয় হারাম বা অবৈধ করেছেন। অনেক ব্যাপারে সময় ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ দীন পালনে যেসব আইন-কানুন, বিধি-বিধান, নিয়ম-পদ্ধতি, হালাল-হারাম, সময় সীমা এবং বৈধ-অবৈধের সীমারেখা প্রদান করেছেন সেগুলো এবং সেগুলোর মূলনীতির সমন্বিত রূপই হলো শরীয়াহ ।

ইসলামী শরিয়তের পরিচয়

শরিয়তের ব্যাখা

শরিয়ত একটি ইসলামী পরিভাষা। আরবী হর এ শব্দটি এ থেকে এসেছে অর্থ রাস্তা, পথ, আদর্শ, মতাদর্শ, মতবাদ, জীবন ব্যবস্থা, আইন, বিধি-বিধান ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে- ‘আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে, রাসূলুল্লাহ আল-হাদীসে এবং সত্যনিষ্ঠ ওলামায়ে মুজতাহিদগণ কুরআন-সুন্নার আলোকে মানবজাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির উদ্দেশ্যে যে আকিদা-বিশ্বাস, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, পথ ও পদ্ধতির নীতিমালা প্রদান করেছেন তাকে শরীয়াহ বলা হয়। শরিয়ত এমন একটি পূর্ণাঙ্গ বিধি-বিধানের সমষ্টি, যাতে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় বিষয় ও ভালো-মন্দের ফয়সালা সন্নিবেশিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল মুহাম্মদ কে দিয়েছেন একটি অনন্যশরিয়ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীয়াহ ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।' (মায়িদা, ৫ পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে- ‘আমি তোমাকে অনুশাসন এর একটি বিশেষ শরীয়ার (পন্থা পদ্ধতির) উপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি এরই অনুসরণ করো আর অজ্ঞ ব্যক্তিদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না।' (জাসিয়া, ৪৫ : ১৮) ‘তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা (যে বিধান) অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা কেবল তারই অনুসরণ করো, তাকে ছাড়া অন্য কোনো অভিভাবকের অনুসরণ করো না। আর তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।' (আরাফ, ৭ : ৩) ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা প্রদান করেন, তখন আর সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কোনো মুমিন পুরুষ বা নারীর নেই। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।' (আহযাব, ৩৩ : ৩৬) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের, আর সে সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। তোমরা যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধ কর, তবে তা (মীমাংসার জন্য) রুজু (refer) করো আল্লাহ এবং রাসূলের নিকট। যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাকো। এটিই সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও উৎকৃষ্ট।' (নিসা, ৪ : ৫৯) শরীয়াহ্ কিছু মানা কিছু না মানার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে গাফেল নন।' (বাকারা, ২ : ৮৫)

শরীয়ার বৈশিষ্ট্য

প্রত্যেক বিষয় বস্তুর কতগুলো গুণ বা বিশেষত্ব থাকে, যার দ্বারা তাকে অপরাপর বিষয় বা বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। ইসলামী শরীয়ার কতগুলো মৌলিক, চিরন্তন গুণ ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে ইসলামী শরীয়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হলো-

ক. আল্লাহপ্রদত্ত বিধান

ইসলামী শরীয়াহ আল্লাহপ্রদত্ত জীবন বিধান। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে এই বিধান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপ্রদত্ত বিধান বলতে এর ভিত্তি ও বিধি-বিধান আল্লাহ তায়ালার দেওয়া। মানুষের মধ্যে স্বভাবসুলভ দুর্বলতা ও অযোগ্যতা থাকে এবং স্থান-কাল, অবস্থা ও সংস্কৃতি দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়, মানুষ পূর্বপুরুষদের মেজাজ, প্রবৃত্তি ও রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে থাকে বলে তাদের রচিত বিধান সবসময় মানুষের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। কিন্তু শরীয়াহ সেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দেওয়া যিনি এ বিশ্বের স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক এবং প্রতিপালক। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি জানেন কিসে তাদের কল্যাণ আর কিসে তাদের পরম উন্নতি ।

খ. আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি

ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। তাই যেখানে আল্লাহপ্রদত্ত বিধান রয়েছে সেখানে আর কোনো বিধান মেনে চলার অবকাশ নেই। কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করতে হলে তা আল্লাহপ্রদত্ত আইন ও এর মূলনীতির আলোকেই করতে হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন- 'বিধান জারি করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর, তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না।' (ইউসুফ ১২:৪০ )

গ. বিশ্ব-মানবতাবাদী

ইসলামী শরীয়াহ এসেছে মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য। মানুষের জান- মাল, ইজ্জত-আবরু, জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদি হিফাযত করা এবং সমাজ থেকে ঝগড়া, বিবাদ, যুলুম, নির্যাতন, সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ করার মাধ্যমে মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ সাধন করাই শরীয়ার উদ্দেশ্য ।

ঘ.পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান

শরীয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি পরিপূর্ণ । শরীয়াহ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে মানুষের যাবতীয় আচার-আচরণকে এর আওতাভুক্ত করেছে। এটি কেবল কতগুলো ইবাদত-বন্দেগি, আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক তথা মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রের বিধিবিধানের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাংঙ্গ করে দিলাম।' (মায়িদা : ৩)

ঙ. অপরিবর্তনীয়

ইসলামী শরীয়ার যে অংশ কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিধৃত হয়েছে তা অপরিবর্তনীয় ও চিরস্থায়ী। স্থান-কাল-পাত্র ও অবস্থার আলোকে তা পরিবর্তন করা যাবে না। যেমন সালাত, সাওম, যাকাত ও হজের মৌলিক বিধান কখনই পরিবর্তন করা যায় না।

চ. পরিবর্তনশীলতা

ইসলামী শরীয়ার মূল উৎস কুরআন-সুন্নার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত আরো কিছু উৎস রয়েছে- যেমন ইজমা, কিয়াস, মাসলাহা, উরফ, ইসতিহসান প্রভৃতি। এগুলোর মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত স্থান-কাল-পাত্র এবং পরিবেশ- পরিস্থিতি ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনযোগ্য। যেমন লেনদেন, ব্যবসা- বাণিজ্য, আর্থ-সামাজিক প্রভৃতি বিধিবিধান যেগুলো মুয়ামালাতের অন্তর্ভুক্ত সেগুলো স্থান-কাল-পাত্র ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইজতিহাদের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায় ।

ছ. যুগোপযোগিতা ও গতিশীলতা

ইসলামী শরীয়াহ যুগোপযোগী ও গতিশীল। কালের আবর্তনে উদ্ভূত সকল সমস্যার সমাধান ইসলামী শরীয়ার আলোকে দেওয়া সম্ভব। সমস্যা যতই কঠিন ও আধুনিক হোক না কেন, যতই বৃহৎ বা ক্ষুদ্র হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই শরীয়ার সমাধান রয়েছে। ইসলামী শরীয়াতে গতিশীলতা ও নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে বলেই তা সময়ের বিবর্তনের মোকাবেলা করতে ও সকল অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সক্ষম। এ কারণে তা কখনো অস্তিত্ব হারায় না, বিনাশও হয় না ।

জ. নমনীয়, উদার ও সার্বজনীন

ইসলামী শরীয়াহ চিরন্তন ও স্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় এতে নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। মানুষের জীবন যেন অচল ও স্থবির হয়ে না যায় সে জন্য এ নমনীয়তার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্য দিকে শরীয়াহ ব্যাপকভিত্তিক উদারতাসম্পন্ন বিধান, এতে কোনো বাড়াবাড়ি ও কঠোরতার স্থান নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিক তাদের বিশ্বাস নিয়ে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার সাথে বসবাস করবে শরীয়াহ তা নিশ্চিত করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম বলেন-আমাকে উদারতাসম্পন্ন দীনসহকারে প্রেরণ করা হয়েছে।' (তবারানি : ৭৮0৩)

ঝ. পরিপালনে সহজ ও কঠোরতা যুক্ত

ইসলামী শরীয়াহ পালন ও অনুসরণ করা খুবই সহজ। এটি পালন করতে গিয়ে কেউ যৌক্তিক সমস্যার সম্মুখীন হলে তার উপর থেকে হুকুমের ভার হালকা ও সহজ করা যায়।

সারসংক্ষেপ

আমাদের জীবনের চলার সবচেয়ে সহজ, সরল ও সুন্দর পথ ইসলামী শরীয়াহ । শরীয়ার নিয়ম-নীতি অনুসারে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url