মুমিনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

মুমিনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

মুমিন হল আরবি ভাষায় ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করা যায় বিশ্বাসী ব্যক্তি। এটি সাধারণত কোরআন ও হাদিসের বিশেষভাবে বর্ণিত ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়। নিম্নলিখিত হল মুমিনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি। মুমিন ঈমানদার হয় এবং অবিচল থাকে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য যা মুসলিম হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়। মুমিন ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাকওয়া করে যাচ্ছে। এটি অর্থ হল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সংজ্ঞা পরিপালন করা, অর্থাৎ আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখা, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এবং ইসলামের সব ধর্মীয় আদেশ পালন করা। মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তাদের মনে সদা আল্লাহর ভয় এটি অর্থ হল তারা তাদের ভুলগুলি চিন্তা করে ও তাদের জন্য তাওবা করে ।

 মুমিনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

মুমিন ও ঈমানদার ব্যক্তি

মুমিন শব্দটির অর্থ বিশ্বাস স্থাপনকারী, স্বীকৃতি প্রদানকারী, আস্থা স্থাপনকারী, স্বীকারকারী ইত্যাদি। পরিভাষায়- আল্লাহ তায়ালা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, পরকাল ও ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনসহ আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত যাবতীয় বিষয়কে যারা সত্য বলে বিশ্বাস করে ও মেনে নেয় তাদেরকে মুমিন বলে। অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তিকেই মুমিন বলা হয় ৷ আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের পরিচয় সম্পর্কে বলেন- রাসূল, তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং মুমিনগণও। তাদের সকলেই আল্লাহে, তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণে ঈমান এনেছে। (তারা বলে) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না, আর তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং পালন করেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাই, আর তোমারই নিকট প্রত্যাবর্তন।' (বাকারা, ২ : ২৮৫) মুমিন ব্যক্তির পরিচয়ে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘মুমিন তো তারাই, যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে। যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যা দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে; তারাই প্রকৃত মুমিন। তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদেরই জন্য রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।' (আনফাল, ৮ : ২-৪)

মুমিন ব্যক্তির গুণাবলি

আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে ভালোবাসেন। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রিয়পাত্র। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মুমিনদের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি আলোচনা করেছেন। ‘আল মুমিনূন’ নামে সূরাও অবতীর্ণ করেছেন। এ সূরাতে মুমিনদের পরিচয় ও গুণাবলি তুলে ধরে তিনি বলেন- ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা নিজেদের সালাতে বিনয় নম্র, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে, যারা যাকাতদানে সক্রিয় ও তৎপর, যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ছাড়া, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না, তবে কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যদেরকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘনকারী, যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং নিজেদের সালাতসমূহে যত্নবান থাকে, তারাই হবে উত্তরাধিকারী। তারা হবে জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।' (মুমিনূন, ২৩ : ১-১১) মুমিন ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর আর সন্দেহে নিপতিত হয় না। তারা ঈমানের উপর দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে—‘তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর সন্দেহ পোষণ করে না।' (হুজরাত, ৪৯ : ১৫) মুমিন ব্যক্তি ভালো কাজে আনন্দ পায় আর অন্যায় কাজে অনুতপ্ত ও বিরত থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘যখন তোমাদের ভালো কাজ তোমাদেরকে আনন্দ দিবে এবং খারাপ ও অন্যায় কাজ তোমাদেরকে অনুতপ্ত করবে তখন তুমি বুঝবে তুমি মুমিন ব্যক্তি।' (মুসনাদে আহমাদ : ২১১৪৫, বায়হাকী : ৫৫০৬)

মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দাদের পরস্পর ভাই ও বন্ধু আখ্যায়িত করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলেছেন- মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু । তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তাদেরকে আল্লাহ কৃপা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।' (তওবা, ০৯ : ৭১ ) কুরআনুল কারীমে আরো বলা হয়েছে—‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।' (হুজুরাত, ৪৯ : ১০) মুমিনদের পরস্পরের সম্পর্কের বন্ধন হবে সুদৃঢ়, ইমারতসদৃশ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- একজন মুমিন আর একজন মুমিনের জন্য ইমারতস্বরূপ। তারা একে অপরকে শক্তিশালী করে। এই বলে তিনি নিজের আঙ্গুলগুলো একটার মধ্যে আরেকটা প্রবেশ করিয়ে পাঞ্জা কষলেন।' (বুখারী : ৪৫৯ ) নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যও পছন্দের বিষয়টি একই হতে হবে, না হলে সে মুমিন হতে পারবে না। পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধনের এ অনুপম দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- তোমাদের কেউ ঈমানদার হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার মুসলিম ভাই-এর জন্যও তাই পছন্দ করে।' (বুখারী : ১২, তিরমিযি : ২৪৩৯, নাসাঈ : ৪৯৩০)

মুমিন ও ঈমানদার হওয়ার শর্ত

ঈমানদার হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল এর প্রতি ঈমান আনয়নের পাশাপাশি তাদের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। এমন কি পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ বলেন- তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।' (বুখারী : ১৪, মুসলিম : ৬৩, নাসাঈ : ৪৯২৭, ইবনে মাজাহ : ৬৬) 'যার মধ্যে তিনটি গুণ আছে সে ঈমানের স্বাদ পায়। ১. তাঁর নিকট অপর সকলের চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রিয়তর হয়, ২. কাউকে ভালোবাসলে আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে, ৩. আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেমন অপ্রিয় মনে করে, কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে তেমন অপ্রিয় মনে করে।' (বুখারী : ১৫) বস্তুত আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার মাপকাঠি হলো: তাঁদের আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধান ও রীতি-নীতি মান্য করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- “বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।' (আলে ইমরান : ৩১ ) মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধীদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে- হোক না এই বিরুদ্ধচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র। তাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ হতে রূহ দ্বারা। তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, এরাই আল্লাহর দল। আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।' (মুজাদালা, ৫৮ : ২২) ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা সবই হতে হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য । তাহলেই সে পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা এবং দান করা ও না করা একমাত্ৰ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সে-ই পূর্ণ ঈমানদার।' (আবু দাউদ : ৪০৬১, তিরমিযি : ২৪৪৫ ) শুধুমাত্র ঈমানদার হলেই চলবে না, তার পাশাপাশি আমলে সালেহ বা সৎ কাজ করতে হবে, পরস্পরকে ধৈর্যধারণ ও সত্যের উপদেশ দিতে হবে। যে এরূপ করবে না সে ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- *মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।' (আসর, ১০৩ : ২-৩)

পরিশেষে 

মুমিনের পরিচয় ও গুণাবলি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ - এর অমীয় বাণী রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তির জন্য সে সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও বাস্তব জীবনে তার অনুসরণে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url