ক্ষণিকের দুনিয়ার জীবনের হাকীকত
ক্ষণিকের দুনিয়ার জীবনের হাকীকত
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবন হলো সামনে যাওয়া সময়ের জন্য একটি মিথ্যা বা অস্থায়ী বিশ্বাস। একজন মানুষ জীবনের একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে জীবন অথবা পৃথিবীকে উপলব্ধি করে সে অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী বা অস্থায়ী সমস্যার সম্মুখীন হবে। কিন্তু জীবন একটি অবিচ্ছিন্ন পথ যা চলতে থাকে এবং বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হতে থাকে। আপনি একটি ক্ষণে আনন্দ পাবেন এবং পরবর্তীতে দুঃখের সাথে মুখোমুখি হবেন। এটি অবিচ্ছিন্ন জীবনের হাকিকত। আমাদের জীবনে সমস্যা, আনন্দ, সফলতা এবং ব্যর্থতা একসাথে থাকে। এই সমস্ত অবস্থাও একটি অবিচ্ছিন্ন জীবনের অংশ এবং প্রত্যেকটি মুহুর্তে পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে, সত্যিকারের জীবন হল একটি নিঃস্থায়ী পরিবর্তনশীল জগত। এটি পরিবর্তনের প্রকৃতি বিশ্বাস করে এবং সেটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে। সমস্ত বিষয় সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটি জ্ঞানপর্যায় থাকে যা সমস্ত পরিবর্তন এবং প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন।
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবন
দুনিয়া এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে যথাক্রমে ইহকাল। প্রতিটি মানব সন্তান মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্য দিয়ে তার পার্থিব জীবন বা ইহকাল জীবন শুরু হয় আর তা অবসান ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের এ ব্যাপ্তিকালকে দুনিয়া তথা ইহকাল বলা হয়। দুনিয়ার বিশ্বময় সম্প্রসারিত অগণন মানব প্রজন্ম, অভিনব আবিষ্কার, বলিষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থা দয়াময় আল্লাহর এক অপার অনুগ্রহ। দুনিয়ার জীবনে প্রথম মানব হযরত আদম ও হাওয়া এর মাধ্যমে ইহজীবনে মানুষের পদচারণা শুরু হয়। দুনিয়ার সকল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক আদম থেকে। কুরআনুল কারীমে সে সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের দুজন হতে বহু নর-নারী সৃষ্টি করেছেন।' (নিসা, ৪ : ১) আল্লাহ তায়ালা শুধু মানবই সৃষ্টি করেন নাই বরং আসমান-জমিনের মাঝে আমাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত যা কিছু আছে সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন।
আসমান-জমিন সৃষ্টি
তিনি আসমান-জমিনের মধ্যস্থিত সবকিছুকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এর অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।' (সাজদা, ৩২ : ৪) দুনিয়ার এ জীবন এবং এর মধ্যস্থিত সকল কিছু সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হলো তাঁর সত্তা ও মহিমার প্রকাশ। গোটা সৃষ্টি তাঁর তাসবীহ, তাহলীল, ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত থেকে তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করছে। কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আধিপত্য ও প্রশংসা তাঁরই, তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।' (তাগাবুন, ৬৪ : ১) আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি জিন এবং মানুষকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমারই ইবাদত করবে।' (যারিয়াত, ৫১ : ৫৬) আল্লাহ দুনিয়া ও মানুষ সৃষ্টি করে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সঠিক দীনসহ যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'তিনিই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে পথ-নির্দেশ ও সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন যাতে একে অন্য সব মতবাদের উপর বিজয়ী করেন। সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।' (ফাতহ, ৪৮ : ২৮) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন এরপর পথপ্রদর্শন করেছেন। (তহা, ২০ : 50 )
সফল মানুষ
দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসৃত পথে জীবনযাপন করবে তারাই সফল। দুনিয়ার জীবনের শুরু এবং শেষ আছে কিন্তু আখেরাত জীবনের কোনো শেষ নেই, এটি অনন্ত ও চিরস্থায়ী জীবন । কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'নিশ্চয় এই পার্থিব জীবন ক্ষণিকের আর নিশ্চয় পরকালই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাসস্থল।' (মুমিন, ৪০ : ৩৯) ‘এরা পার্থিব জীবন নিয়ে উল্লসিত, অথচ দুনিয়ার জীবন তো আখেরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগবিলাস মাত্র।' (রাদ, ১৩ : ২৬) এই পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পরকালের জীবনই প্রকৃত জীবন।' (আনকাবূত, ২৯ : ৬৪) দুনিয়ার জীবন যেখানে মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পদে পদে দিতে হতে পারে পরীক্ষা। মূলত দুনিয়ার এ জীবন পরীক্ষার স্থান। এ জীবনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আখেরাতে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। দুনিয়ার জীবনে মানুষকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন বলে উল্লেখ করে বলেন- ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।' (মূল্ক, ৬৭ : 02 ) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- 'পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা করে দিয়েছি, মানুষকে এই পরীক্ষা করার জন্য যে, এদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।” (কাহাফ, ১৮:০৭ )
দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা
দুনিয়ার প্রতি অতি মোহ বা ভালোবাসাকে সকল অনর্থের মূল বলে অভিহিত করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- তোমার‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা সকল পাপের মূল।' (বায়হাকী : ১০০৬৯) দুনিয়ার জীবন কর্মের, এটি অলসতায় বা হেলায়-ফেলায় কাটিয়ে দেবার জন্য নয়। জীবনের ইহকালকে সুন্দর ও কলুষমুক্ত অবস্থায় যে কাটাতে পারবে তার পরকাল হয় সুন্দর। পার্থিব ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনার মধ্যেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ। শুধুমাত্র দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাসস্থল।' (নাযিয়াত, ৭৯ : ৩৭-৩৯) এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-'মানুষের মধ্যে একদল লোক বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়ায় সবকিছু দিয়ে দাও। তাদের জন্য পরকালে আর কোনো পাওনাই থাকে না। আর এ মানুষদের মধ্যে কেউ বলে হে আমাদের মালিক আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান কর এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও।' (বাকারা, ২: 200-202 ) ইহকালের প্রতিটি কাজ সঠিক ও সৎপথে সম্পন্ন করতে অনুপ্রাণিত করার জন্যই আল্লাহ্ পরকালে ইহকালের যাবতীয় কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। যারা শুধুমাত্র এই পৃথিবীর সুখ, সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি কামনা ও অর্জনে ব্যস্ত, পরকালে সম্বল অর্জনে যাদের ফুসরত নেই, তাদের জন্য পরকালে চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকবে না। মহান আল্লাহ ইহকালের অর্জনকে বড় করে না দেখে পরকালের অর্জনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। পরকালের যা কিছু অর্জন তা করতে হবে ইহকালেই কারণ মৃত্যুর পরে তার পক্ষে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়।
ইহকাল পরকালের চারণভূমি
ইহকাল হলো পরকালের চারণভূমি। পার্থিব জীবনের শস্যক্ষেত্রে আমরা যা রোপণ করব তার প্রতিফল পাওয়া যাবে পরকালে। সুতরাং জীবনের এ চারণভূমিতে আমাদের রোপণ করতে হবে সেই বৃক্ষরাজি যার ফুল, ফল, শাখা-প্রশাখা, যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে। সৎ কাজ করতে হবে বৃহত্তর কল্যাণে ও আল্লাহকে খুশি করার জন্য। এ জগতের কারো সুনাম বা পার্থিব কোনো কিছুর বিনিময়ে তা করা উচিত নয়। এ জন্য ইহকালকে পরকালের ফসলের ক্ষেতের সাথে তুলনা করা হয়। বিশ্ব চরাচরে কোনো মানুষের জীবন চিরস্থায়ী নয়। ইহজীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানব সন্তানকে অনন্ত জীবন দান করিনি। তাই তুমি মরে গেলে ওরা কি চিরঞ্জীব হবে?' (আম্বিয়া, ২১ : ৩৪) পৃথিবীতে একমাত্র নিশ্চিত বিষয় হলো মৃত্যু তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই অথচ নিশ্চিত এ বিষয়ের চেয়ে দুনিয়ার ক্ষণিক জীবনের অনিশ্চিত বিষয়ে আমরা সর্বদা তৎপর থাকি। একজন মুসলমানের করণীয় হলো দুনিয়ার জীবনের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করা। এ জন্য নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যবান মনে করো— জীবনের পূর্বে মৃত্যুকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে, দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতা বা প্রাচুর্যকে, বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে।' (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ১৮, মুসতাদরাক : ৭৯৫৭, বায়হাকী : ৯৮৮২)
পরিশেষে
পৃথিবীর সকলেই দুনিয়ার এ দৃশ্যমান জীবনের প্রতি বিশ্বাস করে কিন্তু অনেক ব্যক্তি আখেরাতের অনন্ত জীবনের প্রতি বিশ্বাস করতে চায় না।
Read More: বিশুদ্ধ আকিদা ও রিসালাত