ফরয ওয়াজিব সুন্নত নফল বা মুস্তাহাব এর গুরুত্ব তাৎপর্য

ফরয ওয়াজিব সুন্নত নফল বা মুস্তাহাব

ফরয ওয়াজিব সুন্নত নফল বা মুস্তাহাব এর গুরুত্ব তাৎপর্য

ফরয

ফরয শব্দটি আরবী, এর আভিধানিক অর্থ নির্ধারিত বা অবশ্য পালনীয়। আল্লাহ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় আদেশ। যা দলীলে কাতঈ (অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত)। আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলমানের প্রতি তা অপরিহার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। ফরয অস্বীকারকারী কাফির বলে গণ্য হবে। এর পরিত্যাগকারীর জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। শরীয়তের পরিভাষায় এ জাতীয় ব্যক্তিকে 'ফাসিক' বলা হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমযান মাসের সাওম, নিসাব পরিমাণ বা তার অধিক অর্থ সম্পদের উপর শরীয়ত নির্ধারিত হারে বার্ষিক যাকাত দান, সামর্থ্য হলে জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরয। রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে, যথা: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায় করা, হজ পালন করা এবং রমযানে সিয়াম পালন করা। ' (বুখারী : ৭) আল কুরআনে সূরা নূরের প্রথমেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে- ‘এটি একটি সূরা এটা আমি অবতীর্ণ করেছি এবং এর বিধানকে অবশ্যপালনীয় করেছি। এতে আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।' (নূর ২৪ : ১) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ শব্দটি উল্লেখ করে বলেন- এ ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।' (ইবনে মাজাহ : ২২০, বায়হাকী : ১৬১৩) ফরয দুই প্রকার, যথা: ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া। ফরযে আইন : এর অর্থ ব্যক্তি বাধ্যবাধকতা, যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর সমানভাবে ফরয, যে আদায় করবে না সেই গুনাহগার হবে। যেমন: সালাত, সাওম, হজ ইত্যাদি ফরযে কেফায়া : এর অর্থ সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা, যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর সমানভাবে ফরয তা একটি এলাকায় সবার পক্ষ থেকে কিছুসংখ্যক লোক আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। যেমন : জানাযার সালাত । আল্লাহ তায়ালা বান্দার উপরে যে সমস্ত কাজ ফরয করে দিয়েছেন, সে সমস্ত কাজ সঠিক ও সুন্দরভাবে পরিপালনের মাধ্যমেই তাঁর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ সম্ভব হবে।

ওয়াজিব

ওয়াজিব শব্দটিও আরবী। ওয়াজিব ফরযের মত অবশ্য পালনীয় তবে গুরুত্বের দিক থেকে ফরযের পরে ওয়াজিবের স্থান। বিনা কারণে তা পরিত্যাগ করলে ফাসিক হবে এবং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে বিবেচিত হবে । শরীয়তের ওয়াজিব বিধানকে গুরুত্বহীন মনে করা সরাসরি গোমরাহী। তবে কোনোরূপ তাবীলের (ব্যাখ্যা) আশ্রয় নিয়ে অথবা সন্দেহমূলে ওয়াজিবকে অস্বীকার করলে কাফির হবে না। কেননা ফরয বিধানের মত দলীলে কাতঈ (অকাট্য) প্রমাণ দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়নি। ওয়াজিব সাবিত (সাব্যস্ত) হয়েছে দলীলে যন্নী (সন্দেহযুক্ত প্রমাণ) দিয়ে। যেমন বিতরের তিন রাকাত সালাত। সালাতের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়া । ফরয ও ওয়াজিবের পার্থক্য ফরয বা ওয়াজিব দুইটি শব্দেরই অর্থ বাধ্যতামূলক। এই দুইয়ের মধ্যে শব্দগত পার্থক্য থাকলেও অর্থগত তেমন কোনো পার্থক্য নাই। অধিকাংশ আলেম এই দুইটি শব্দকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন । ফরয হচ্ছে যে বিধান দলীলে কাতঈ (অকাট্য) প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত। যেমন- সালাত কায়েম করা, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সঙ্গে রুকু কর।' (বাকারা, ২:৪৩ ) সিয়াম সাধনা করা, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সাওম ফরয করা হলো, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।' (বাকারা, ২: ১৮৩) জার ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় দলীলে যন্নী (সন্দেহযুক্ত প্রমাণ) দিয়ে। যেমন- সালাতে সূরা ফাতিহা পড়া, এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- কি 'যে ব্যক্তি সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার সালাত হলো না।' (বুখারী : 458)

সুন্নত

সুন্নত শব্দটি আরবী, এর আভিধানিক অর্থ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি । ফরয এবং ওয়াযিব ব্যতীত দীনের যে সকল কাজ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে করেছেন, করার নির্দেশ দিয়েছেন বা অনুমোদন করেছেন শরীয়তের পরিভাষায় তাকে সুন্নত বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা নিয়মিত করেছেন, তবে মাঝে মধ্যে ছেড়েও দিয়েছেন যাতে উম্মতের জন্য বাধ্যতামূলক না হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা রাসূল অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ তো শাস্তি দানে কঠোর।' (হাশর, ৫৯ : ৭) এ ছাড়া খোলাফায়ে রাশেদীন দীনের যে সকল কাজ প্রবর্তন করেছেন সেগুলোও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে থেকে যে বেঁচে থাকবে সে অচিরেই অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে, তখন তোমাদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য আমার সুন্নত এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা।' (আবু দাউদ : ৩৯৯১, মুসনাদে আহমাদ : ১৬৫১৯) সুন্নত দুই প্রকার, ১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ২. সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ। ১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ : সে সব কাজ যা রাসূলুল্লাহ্(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবাদত হিসেবে নিয়মিতভাবে আদায় করেছেন তবে ওযরবশত কখনো কখনো ছেড়ে দিয়েছেন তাই সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। যেমন ফজরের দুই রাকাত সুন্নত । ২. সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ : সে সকল কাজ যা রাসূলুল্লাহ অভ্যাসগতভাবে নিয়মিত করেছেন এবং বিনা কারণে কখনো ছেড়েও দিয়েছেন তাই সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ। যেমন আছরের চার রাকাত ফরযের আগে চার রাকাত সুন্নত । রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উম্মত হিসেবে যে সকল কাজের পথ দেখিয়ে গেছেন তা আমাদের পালন করা উচিত, যাতে করে কিয়ামতের দিন তাঁর সুপারিশ আমাদের নসীব হয় ।

নফল বা মুস্তাহাব

নফল বা মুস্তাহাব যে কাজ রাসূলুল্লাহ র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অথবা তাঁর সাহাবীগণ নিয়মিত করেননি বরং মাঝে মধ্যে সময়সুযোগ' অনুযায়ী করেছেন তাকে নফল বা মুস্তাহাব বলে । এ সব কাজ রাসূলুল্লাহ অন্যদেরকে করার জন্য উৎসাহিত করেছেন । মুস্তাহাব আদায় করলে অনেক সওয়াবের অধিকারী হওয়া যাবে। তবে না করলে কোনো গুনাহ হবে না। নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। হাদীসে কুদসিতে এসেছে- ‘আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নিই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোনো কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে এটাতে কোনো রকম দ্বিধা সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা সংকোচ মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে করি সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্টকে অপছন্দ করি।' (বুখারী ৬০২১) , ফকীহগণের পরিভাষায় মুস্তাহাবকে নফল, মানদূব ও তাতাউও বলা হয়ে থাকে । কতিপয় নফল কাজ হচ্ছে তাহাজ্জুদ সালাত, রমযান ছাড়া রোযা রাখা, দান-সাদাকাহ করা ইত্যাদি ।

পরিশেষে

আল্লাহ তায়ালা বান্দার উপরে যে সমস্ত কাজ ফরয করে দিয়েছেন, সে সমস্ত কাজ সঠিক ও সুন্দরভাবে পরিপালনের মাধ্যমেই তাঁর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ সম্ভব হবে। রাসূলুল্লাহ এর উম্মত হিসেবে যে সকল কাজের পথ দেখিয়ে গেছেন তা আমাদের পালন করা উচিত, যাতে করে কিয়ামতের দিন তাঁর সুপারিশ আমাদের নসীব হয় ।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • Maruf
    Maruf ৪ মে, ২০২৩ এ ১০:৪৯ PM

    Very nice

Add Comment
comment url