হালাল হারাম মাকরূহের পরিচিতি ও গুরুত্ব

হালাল হারাম মাকরূহের পরিচিতি

হালাল শব্দটি আরবি ভাষায় "অনুমোদিত", "সমর্থিত" বা "জায়েজ" অর্থ হয়। এটি খাদ্য, পানীয়, পশুপালন ও পণ্যের উৎপাদন, ব্যবসায় ও আর্থিক সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ পরিচিতি পায়। হারাম হল এমন খাবার, পন্য, বা আমল যা ইসলামিক শারিয়তে এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী মান্য নয়। হারাম খাদ্যদ্রব্য মানবের স্বাস্থ্য, মনঃশান্তি, আদাব-আপরাধপূর্ণতা, এবং সামাজিক একতা এবং মানব সম্পদের বিভিন্ন দিকে প্রতিবন্ধিত হওয়ার কারণে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

হালাল হারাম মাকরূহের পরিচিতি ও গুরুত্ব

হালালের পরিচিতি

হালাল শব্দটি আরবী এর আভিধানিক অর্থ বৈধ, সিদ্ধ, জায়েজ ইত্যাদি। পরিভাষায় শরীয়ার দৃষ্টিতে যে সকল বস্তুর ব্যবহার বা কাজ বৈধ তাকে হালাল বলে । হালাল হারাম ইসলামী শরীয়াহ এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হালাল হারাম নির্ধারণে মানুষের ইখতিয়ার নেই। হালাল হারাম নির্ধারণের অধিকার একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। পৃথিবীতে এমন অনেক বস্তু আছে যেগুলো অবৈধ ও হারাম হলে মানুষের পক্ষে জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে যায়। তাই ফকীহগণ মনে করেন সকল বস্তুর মূল দাবী হলো হালাল ও বৈধ হওয়া। আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভি তাঁর গ্রন্থের এ বলেন -‘জাগতিক বিষয়ে মূলনীতি হচ্ছে বৈধতা।' যতক্ষণ পর্যন্ত দলীল দ্বারা কোনো বস্তুর অবৈধতা ও নিষিদ্ধতা প্রমাণিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে হালাল ও বৈধই মনে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে যা যা হালাল বলেছেন তাই হালাল এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে যা যা হারাম বলেছেন তাই হারাম। আর যে সব বিষয়ে কিছু বলেননি সেসব বিষয়ে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। (তিরমিযি : ১৬৪৮, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩৫৮) আল্লাহ তায়ালা হালাল ভক্ষণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার করো। আর তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।' (বাকারা, ২ : ১৬৮)

হারামের পরিচিতি

হারাম শব্দটি আরবী, শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ, বিরত থাকা ইত্যাদি। যে গণ্ডি কিংবা প্রাচীর কোনো কিছু কূপে পড়তে বাধা দেয় তাকে ‘হারীম’ বলে। ফিকহের পরিভাষায় নিষিদ্ধ বিষয়াবলিকে বলে হারাম । আল্লামা আমাদী (রাহিমাহুল্লাহ তায়ালা) হারামের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- ‘নিজ কৃতকর্ম হিসাবে যা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দার কারণ হয় তাই হারাম।' যে সকল কাজ নিষিদ্ধ হওয়া অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত, একে হারাম বলা হয়। বিনা ওযরে যে এমন কাজ করে সে ফাসিক। কঠিন আযাব তার জন্য নির্ধারিত। হারামের অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে। ফরয এবং হারাম প্রমাণের দিক দিয়ে একই পর্যায়ের। ফরয কাজ করা যেমন অবশ্য কর্তব্য তেমনিভাবে হারাম কাজ বর্জন করাও অবশ্য কর্তব্য। হারামের মূলনীতি সম্পর্কে আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভি তাঁর গ্রন্থের এ বলেন- ‘যা কিছু হারামের দিকে ধাবিত করে তা হারাম । আল কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে তাই হারাম। শরীয়তের হালাল হারামের বিষয়গুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘হালালও স্পষ্ট হারামও স্পষ্ট।' (বুখারী : ৫০, মুসলিম : ২৯৯৬ ) পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা শব্দটি উল্লেখ করে বলেন- 'আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।' (বাকারা, ২ : 275 ) হারাম বস্তু বা কাজ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের জন্যই অকল্যাণকর। হারাম খাদ্য ও হারাম উপার্জনের খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সতর্ক করে বলেন- ‘যে গোশত হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হারাম খাদ্য গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামের আগুনই উত্তম।' (তবারানি : ১৫৬২৯) আল্লাহ তায়ালা যে সব কাজ করা, বলা ও গ্রহণ করা হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

মাকরূহের পরিচিতি

মাকরূহ শব্দটি আরবী। এর আভিধানিক অর্থ অপছন্দনীয় কাজ। অপছন্দনীয় বস্তু বা আচরণই মাকরূহ। পরিভাষায় যে কাজ বা আচরণ কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় তাকে মাকরূহ বলা হয়। মাকরূহ হারামের কাছাকাছি একটি শব্দ। অকাট্য দলীল দ্বারা নিষিদ্ধ বিষয়াবলিকে ফকীহগণ হারাম বলেছেন আর যে সব বিষয়ের নিষিদ্ধতা সম্পর্কে অকাট্য দলীল নেই সেগুলোকে সতর্কতাস্বরূপ মাকরূহ বলেছেন। সুতরাং ফরযের বিপরীতে ওয়াজিব যেমন ঠিক হারামের পাশে মাকরূহ তেমনিই। ফরযের কাছাকাছি বিধায় যেমন ওয়াজিব বর্জন করলে পাপ হয় তেমনি হারামের কাছাকাছি বিধায় মাকরূহে তাহরীমির শিকার হলেও গুনাহ হয়। কতিপয় মাকরুহ হচ্ছে- ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ তায়ালা) এর মতে, গৃহপালিত গাধা, গাধীর গোশত খাওয়া এবং গাধীর দুধ ও উটের পেশাব পান করা মাকরুহ । ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ তায়ালা) এর মতে, সিসা, কাচ, চীনামাটি ও আকীক পাথর দ্বারা প্রস্তুতকৃত পাত্র ব্যবহার মাকরূহ । ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (রাহিমাহুল্লাহ তায়ালা) এর মতে, রেশমের বালিশে হেলান দেওয়া এবং তার উপর নিদ্রা যাওয়া মাকরূহ। ইমাম মুহাম্মদের মতে, দাবা খেলা, নরদেশীর খেলা ও তাসের খেলা মাকরূহ। (হেদায়া : কিতাবুল কারাহিয়্যাহ)

পরিশেষে

হালাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি শুরু হয় আল্লাহর হুকুম এবং নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সুন্নাত ও হাদিস এর উপর। হালাল খাবার মানবের প্রাথমিক প্রার্থনার জন্য একটি ধর্মিক আদর্শ। ইসলামে হালাল খাবার খাওয়া মানবকে পরম সম্মান এবং আত্মগৌরব দেওয়া হয়। হারাম পদার্থ নিষিদ্ধ হওয়া ইসলামের ধার্মিক শর্তগুলি লঙ্ঘিত হলে মানবের ধর্মিক পালন সংকটে পড়ে। এটি ইসলামিক আদর্শ এবং আকীদা অবলম্বনের বিপরীত। হারাম পদার্থ মানবের অধিকারে লঙ্ঘিত হলে মানবকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়। হারাম পদার্থের ব্যবহার মানবকে ন্যায়বিচারিণী কর্মপ্রণালীর প্রতি শ্রদ্ধা হানি করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url