সাদাকাহ দান কাফ্ফারার গুরুত্ব ও ফজিলত

সাদাকাহ দান কাফ্ফারা

সাদাকাহ দান কাফ্ফারার গুরুত্ব ও ফজিলত

সাদাকাহ বা ফিতরা

সাদাকাহ আরবী শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ দান । আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য সম্পদের যে অংশ ব্যয় করা হয় তাকে সাদাকাহ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ৯টি স্থানে যাকাতকে সাদাকাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার রমযানের রোযা রাখার পর ঈদুল ফিতরের সালাতের পূর্বে যে ফিতরা দিতে হয় তাকেও সাদাকাহ বলা হয় ।

সাদাকাহ বা দান করলে তার প্রতিদান বহুগুণ দেওয়া হবে বলে দান করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ বেশি এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।' (হাদীদ, ৫৭ : ১৮) অন্যকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে দান করা যেতে পারে। তবে গোপনে দান করাই উত্তম। দান করে সে দানের কথা বলে বেড়ানো যাবে না। এভাবে দানের প্রচার হীনম্মন্যতার পরিচায়ক। প্রচারসর্বস্ব দান সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে বলে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনগণ! দানের কথা বলে বেড়িয়ে এবং (দানগ্রহীতাকে) কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে ঐ ব্যক্তির ন্যায় নিষ্ফল করো না, যে নিজের ধনসম্পদ লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান রাখে না।' (বাকারা, ২ : ২৬৪) যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য দান করে তার প্রতিফল দয়াময় আল্লাহর নিকট রয়েছে উল্লেখ করে কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- 'যারা নিজেদের ধন-সম্পদগুলো রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের পুণ্যফল তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে, তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।' (বাকারা, ২ : ২৭৪) দান সাদাকাহ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা যেমন উৎসাহ দিয়েছেন, তাঁর প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও দান-সাদাকার ব্যাপারে অনেক উৎসাহ প্রদান করেছেন। দান যত ক্ষুদ্র বস্তুরই হোক না কেন সেটা হতে হবে হালাল উপার্জনের বস্তু । হালাল উপার্জন হতে দানকৃত বস্তু আল্লাহ তায়ালা ডান হাতে গ্রহণ করেন এবং তা বিশাল পাহাড়ের ন্যায় বর্ধিত করে দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন হতে একটি খেজুর সমপরিমাণ সাদাকাহ করবে আল্লাহ তায়ালা তা ডান হাতে গ্রহণ করবেন। আর আল্লাহ তায়ালা তো হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না। অতঃপর তা তার কল্যাণেই বর্ধিত করবেন যেমনিভাবে তোমাদের কেউ একটি ঘোড়ার বাচ্চাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করে বর্ধিত করে। এমনকি আল্লাহ তায়ালা সে খেজুর সমপরিমাণ বস্তুটিকে একটি পাহাড় সমপরিমাণ বানিয়ে দেন। (বুখারী : ১৩২১, মুসনাদে আহমাদ : ৮০৩১) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দানের জন্য উৎসাহ প্রদান করে আরো বলেন- ‘দান গুনাহসমূহকে মুছে দেয়, যেমনিভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।' (তিরমিযি : ৫৫৮, ইবনে মাজাহ : ৪২০০ )

দান বা হেবা

দান শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হেবা । পরিভাষায় বিনা প্রতিদানে কোনো বস্তু অন্যের মালিকানায় দিয়ে দেওয়াকে হেবা বা দান বলে। ব্যক্তিগত আয়ের উপায়-উপকরণসমূহের মধ্যে দানও একটি কল্যাণকর পদ্ধতি। দানের কল্যাণকর বিষয় হলো এই যে, কোনো বিত্তবান ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের পরও যদি তার অতিরিক্ত সম্পদ থাকে, তবে তার জন্য সমীচীন হলো, অতিরিক্ত মূলধন কোনো অভাবী ব্যক্তির অভাব দূরীকরণে ব্যয় করা। ধনী-গরিব সকলকেই দান করা যায় ! তবে গরিব মানুষকে দান করা উত্তম। দান এবং হাদিয়ার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।

দান করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিম্বরে দাঁড়িয়ে দান করা ও ভিক্ষা করা থেকে বেঁচে থাকার বিষয়ে বলেন- ‘উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা উত্তম। আর সেই উপরের হাত হলো দাতার এবং নীচের হাত ভিক্ষুকের।' (বুখারী : ১৩৩৯) দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদা বাড়িয়ে ‘দানশীলতা জান্নাতের একটি বৃক্ষ, এর ডালপালাসমূহ দুনিয়াতে ছড়িয়ে আছে। যে এর কোনো একটি ধারণ করবে তা তাকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। আর কৃপণতা জাহান্নামের একটি বৃক্ষ, এর ডালপালাসমূহও দুনিয়াতে ছড়িয়ে আছে। কেউ এর কোনো ডাল ধারণ করলে তা তাকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দিবে।' (বায়হাকী : ১০৪৪৯) দানকারীর কর্তব্য হলো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করা। উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করা, উত্তম সম্পদ থেকে দান করা, যথাসম্ভব গোপনে দান করা এবং তা বলে না বেড়ানো ।

কাফ্ফারা এবং ফিদিয়া

কাফফারা শব্দটি আরবী, এর আভিধানিক অর্থ প্রতিকার করা, প্রায়শ্চিত্ত করা, মাশুল দেওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায়, শরিয়াহর বিধি পালনে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে গেলে কিংবা কোনো আবশ্যকীয় কাজ ছুটে গেলে সে ভুল সংশোধনের জন্য দণ্ডস্বরূপ যে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় তাকে কাফ্ফারা বলে। আল্লাহ তায়ালার নামে ইচ্ছা করে শপথ করে কেউ যদি তা ভঙ্গ করে তাহলে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমাদের বৃথা শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে দায়ী করবেন না, কিন্তু যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কর সে সবের জন্য তিনি তোমাদেরকে দায়ী করবেন। এর কাফফারা হলো দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের আহার দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান কর কিংবা একজন দাসমুক্তি কর। যার সামর্থ্য নাই সে তিন দিন সিয়াম পালন কর। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের জন্য শপথের কাফফারা। তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করিও।' (মায়িদা, ৫ : ৮৯) রাসূলুল্লাহ সালাতের কাফ্ফারা বিষয়ে বলেন- ‘যদি কেউ কোনো সালাতের কথা ভুলে যায়, তাহলে যখনই স্মরণ হবে, তখনই তাকে তা আদায় করতে হবে। এ ছাড়া সালাতের অন্য কোনো কাফফারা নেই।' (বুখারী : ৫৬২) কাফফারা বিষয় নিয়ে সুন্দর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নিম্নের হাদীসটিতে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘তোমরা আমার কাছে এই মৰ্মে বাইয়াত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কিছু শরিক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেবে না এবং নেক কাজে নাফরমানি করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূরণ করবে, তার বিনিময় আল্লাহর কাছে। আর কেউ এর কোনো একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তবে তা হবে তার জন্য কাফফারা।' ( বুখারী : : ১৭) এভাবে আল্লাহ তায়ালা যিহারের (মাহরাম মহিলার শরীরের কোনো অঙ্গের সাথে স্ত্রীর অঙ্গের তুলনা) কাফফারা সর্ম্পকে বলেন- 'যারা নিজেদের স্ত্রীগণের সঙ্গে যিহার করে এবং পরে তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তবে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাস মুক্ত করতে হবে, এ দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। তোমরা যা কর আল্লাহ তার খবর রাখেন।' (মুজাদালা, ৫৮ : ৩)

পরিশেষে

কেউ ইচ্ছা করে রোযা ভঙ্গ করলে তার উপর ধারাবাহিক দুই মাস রোযা রাখা, অসমর্থ হলে ষাটজন মিসকিনকে একদিন দুইবেলা অথবা একজন মিসকিনকে ষাটদিন দুইবেলা পেট ভরে খাওয়ানো, তাও সম্ভব না হলে একজন ক্রীতদাস মুক্তির কাফফারা ওয়াজিব হয় । দানকারীর কর্তব্য হলো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করা। উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করা, উত্তম সম্পদ থেকে দান করা, যথাসম্ভব গোপনে দান করা এবং তা বলে না বেড়ানো ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url