মানত ও কসম ভঙ্গের কাফ্ফারা

মানত ও কসম

মানত ইবাদতের উদ্দেশ্যে বা অনর্থক কিংবা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানিমূলক হোক সে সম্পর্কে তিনি অবগত । আল্লাহ তায়ালা বলেন- “যা কিছু তোমরা ব্যয় কর অথবা যা কিছু তোমরা মানত কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তা জানেন। আর যালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।' (বাকারা, ২: ২৭0 )কারো সম্পদ আত্মসাতের জন্য মিথ্যা কসম করা যাবে না। এরূপ মিথ্যা কসমকারীর উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘যে ব্যক্তি অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য (মিথ্যা) কসম করে সে কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে তখন তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন।' (বুখারী : ২৪৭৭)

মানত ও কসম ভঙ্গের কাফ্ফারা

মানত বা মান্নত

মানত শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিজের দায়িত্বে নেওয়া বা যা নিজের দায়িত্ব নয় তা অপরিহার্য করে নেওয়া, উৎসর্গ, ভয়-ভীতি ইত্যাদি। নিজের উপর এমন কিছু ওয়াজিব (আবশ্যিক) করে নেওয়া যা আসলে ওয়াজিব ছিল না। সেটা শর্তযুক্তও হতে পারে আবার শর্তমুক্তও হতে পারে। মানত বা মান্নত আমাদের সমাজে বহুলপ্রচলিত একটি কাজ । যেমন আমরা কখনো কখনো বলি, যদি আমার চাকরিটা হয়ে যায় তাহলে আমি আল্লাহ তায়ালার ওয়াস্তে প্রথম মাসের বেতন সাদাকাহ দিব। এটি একটি মানত। অর্থাৎ কোনো বিষয় অর্জিত হওয়ার শর্তে কোনো কিছু করার ওয়াদাকে সাধারণত আমরা মানত বলে থাকি । রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন- 'তোমরা মানত করবে না, কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।' (মুসলিম : ৩০৯৮, তিরমিযি : ১৪৫৮ ) তবে যদি কেউ মানত করে ফেলে তাহলে তাকে তা পালন করতেই হবে । যাকে আমরা বলি মানত পুরা করা। মানত পুরা করা ওয়াজিব, না করলে গুনাহ হবে । আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের।' (হজ, ২২ : ২৯) কেউ যদি কোনো ভালো কাজ করার মানত করে তাহলে তাকে তা পালন করতে হবে। আবার অনর্থক বা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানিমূলক মানত পূরণ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করার মানত করে সে যেন তার আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করার মানত করে সে যেন নাফরমানি না করে।' (বুখারী : ৬২০৬, তবারানি : ৬৫৪৬) কৃত মানত যদি সওয়াবের কিংবা ইবাদতের বিষয়ে হয় তাহলে তা আদায় করতে হবে। মৃত্যুবরণকারীর মানত হলেও তা আদায় করতে হবে। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে এসে বললো, 'আমার বোন হজ করবে বলে মানত করেছিল অথচ সে মারা গিয়েছে। তখন রাসূল বলেন- আমার মা ‘তার উপর যদি কোনো ঋণ থাকতো তবে কি তা তুমি পূরণ করতে না? লোকটি বললো 'হ্যাঁ' তিনি বললেন ‘সুতরাং আল্লাহ তায়ালার হককে আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহর হক আদায় করাটা তো অধিক কর্তব্য।' (বুখারী : ৬২০৫ ) মানত ইবাদতের উদ্দেশ্যে বা অনর্থক কিংবা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানিমূলক হোক সে সম্পর্কে তিনি অবগত । আল্লাহ তায়ালা বলেন- “যা কিছু তোমরা ব্যয় কর অথবা যা কিছু তোমরা মানত কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তা জানেন। আর যালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।' (বাকারা, ২: ২৭0 ) তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি, মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি । (মুসলিম : ৩০৯৮)

কসম বা শপথ

কসমের আভিধানিক অর্থ হলো শপথ, শক্তি, ডান হাত। ইসলামী পরিভাষায় এমন এক শক্তিময় বন্ধনকে বুঝায় যার দ্বারা কসমকারী ব্যক্তির কোনো কাজ করা বা না করার ইচ্ছা দৃঢ় করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার নাম কিংবা সিফাত উল্লেখ করে শপথকৃত বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করার নামই কসম বা শপথ ৷ আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির মধ্য হতে যার নামে ইচ্ছা কসম করতে পারেন। কিন্তু সৃষ্টির জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে কসম করা জায়েয নাই। কসম মূলত এক প্রকার সম্মান, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ পাওয়ার যোগ্য নয়। যেমন হাদীসে এসেছে একবার রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে এমন এক সময় পৌঁছলেন যখন তিনি তাঁর পিতার নামে কসম করছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ডেকে বললেন- ‘সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে বাপ-দাদার নামে কসম করতে নিষেধ করেছেন। কাউকে যদি কসম করতেই হয় তাহলে সে যেন আল্লাহর নামে কসম করে । অন্যথায় চুপ থাকে।' (বুখারী : ৫৬৪৩ ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেন- ‘যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করলো সে শিরক করলো।' (আবু দাউদ : ৫৬৪৩, মুসনাদে আহমাদ : ৫১২০ ) আল্লাহ তায়ালার নাম ব্যতীত কসম করা যেমন জায়েয নেই তেমনি কোনো কাজের কসম করে সে কাজ না করলে বা কসমের ভঙ্গ করলে আল্লাহ তায়ালা কসমকারীকে তার জন্য দায়ী করবেন। কসম ভঙ্গ করার জন্য তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে। কসমের কাফফারা কি ধরনের হবে তা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের বৃথা শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে দায়ী করবেন না, কিন্তু .যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কর সে সবের জন্য তিনি তোমাদেরকে দায়ী করবেন। অতঃপর এর কাফফারা দশজন দারিদ্রকে মধ্যম ধরনের আহার্যদান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদের খেতে দাও অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান কিংবা একজন দাসমুক্তি। আর যে ব্যক্তির (এর একটিও করতে) সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটিই তোমাদের শপথের কাফফারা, তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করিও এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর বিধানসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন। যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।' (মায়িদা, ৫ : ৮৯) পাপ কাজের কসম করা নিষিদ্ধ। পাপ কাজে কসম করলে সে কসম ভঙ্গ করে কাফফারা আদায় করতে হবে। আবার কোনো বিষয়ে কসম করে তার বিপরীতে উত্তম মনে হলে উত্তম বিষয়টি সম্পাদন করে কাফফারা আদায় করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ের উপরে কসম করে, পরে তার বিপরীতটিকে তার চেয়ে উত্তম মনে করে, তবে সে যেন সে উত্তম বিষয়টি সম্পাদন করে এবং তার কসমের কাফফারা আদায় করে দেয়।' (মুসলিম : ৩১১৫, নাসাঈ : ৩৭২৫) কারো সম্পদ আত্মসাতের জন্য মিথ্যা কসম করা যাবে না। এরূপ মিথ্যা কসমকারীর উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘যে ব্যক্তি অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য (মিথ্যা) কসম করে সে কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে তখন তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন।' (বুখারী : ২৪৭৭)

পরিশেষে

খুব বেশি প্রয়োজন হলেই কসম করবে এবং তা আল্লাহ তায়ালার নামে কসম করতে হবে। এছাড়া যেনতেন বিষয়ে কসম না করা এবং কসম করে সে কসমের কাজ সম্পাদনের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url