ইসলামে করনীয় ও বর্জনীয় কাজ (পর্ব-০১)

ইসলামে করনীয় ও বর্জনীয় কাজ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম যা মানুষের জীবনের সকল দিক নিয়ে উপদেশ দেয়। ইসলামে করনীয় এবং বর্জনীয় কাজের প্রমুখ তথ্যগুলো নিম্নে দেওয়া হলো: করনীয় কাজ:কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করা: কালেমা শাহাদাত হলো ইসলামের সর্বপ্রথম এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস। মুসলমান থাকতে হলে কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক। কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করলে কোন ব্যক্তি মুসলমান হয়ে উঠে।নামাজ পড়া: নামাজ পড়া ইসলামের প্রধান ধর্মীয় কর্ম। নামাজ পড়া মুসলমান ধর্মের চার মুখ্য স্তম্ভের একটি। এটি প্রতিদিন পাঁচ বার পড়া হয়।রোজা রাখা: রোজা রাখা হলো ইসলামের একটি বিশেষ সুন্নত। এটি রমজান মাসে প্রতিদিন পুরো মাস রাখা হয়।যাকাত দেওয়া: যাকাত হলো ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।হজ্জ পালন করা।বর্জনীয় কাজসমূহ:শিরক করা যাবে না।জুলম করা বা সম্পদ চুরি করা যাবে না।মানব হত্যা করা যাবে না।কোনো ব্যক্তির খারাপ কাজে সহায়তা না করা।

ইসলামে করনীয় ও বর্জনীয় কাজ (পর্ব-০১)

ইসলামে গর্ব ও অহংকার করা নিষেধ

গর্ব ও অহংকার মানবীয় মৌলিক বর্জনীয় দোষ-ত্রুটির মধ্যে অন্যতম। সকলের মাঝে নিজেকে বড় ও মহৎ বলে মনে করার মিথ্যা অনুভূতি জাগ্ৰত হওয়া এবং নিজেকে সবার চেয়ে বড় বলে মনে করার মাধ্যমে গর্ব ও অহংকারের সৃষ্টি। অহংকার ও আত্মম্ভরিতার বহুবিধ কারণ থাকতে পারে । মানুষ সাধারণত বংশ-কুল, রূপ-সৌন্দর্য, ধন-দৌলত, উচ্চপদ, উচ্চশিক্ষা, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বন্ধু-বান্ধব ও সাহায্যকারীর আধিক্যের কারণে অহংকার করে থাকে। অহংবোধের কারণেই ইবলিস শয়তান আল্লাহ তায়ালার লানতে পড়েছিল এবং জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। অহংবোধ ব্যক্তিকে উদ্ধত পরিণত করে সর্বত্র বিপর্যয় ও অনাচার সৃষ্টি করে পরিণতিতে একসময় সে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং গর্ব অহংকার বর্জন করে চলা মুমিনের চরিত্র। আল্লাহ গর্ব ও অহংকার করার বিষয়ে স্পষ্ট সাবধান বাণী উল্লেখ করে বলেন- 'লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না আর জমিনের উপর অহংকার করে চলাফেরা করো না। আল্লাহ কোনো আত্ম অহংকারী ও দাম্ভিককে পছন্দ করেন না।' (লুকমান, ৩১ : ১৮) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- অহংকারের পরিণাম সম্পর্কে বলেন- 'যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।' (মুসলিম : ১৩১, তিরমিযি : ১৯২২) হাদীসে কুদসীতে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অহংকার আমার চাদর এবং শ্রেষ্ঠত্ব আমার পোশাক । অনন্তর যে এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে কাড়াকাড়ি করবে তাকে আমি জাহান্নামে ছুড়ে মারব।' (মুসনাদে আহমাদ : ৭০৭৮)

ইসলামে হিংসা-বিদ্বেষ করা নিষেধ

হিংসা-বিদ্বেষ মানব চরিত্রের একটি মারাত্মক নেতিবাচক বিয়য়। হীনমানসিকতা, শত্রুতা, অহংকার, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদা বা নেতৃত্বের লোভ থেকেই হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম হয়। ব্যক্তি চরিত্র গঠনে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে মানুষে মানুষে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়, সমাজের শান্তি-শৃংখলা নষ্ট হয় এবং বিপর্যয় দেখা দেয়। হিংসুটে ব্যক্তি অন্যের সুখ-শান্তি, সম্পদ বিনষ্ট করে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা ও বাসনা পোষণ করে। অপরের উন্নতিতে সে অন্তরে জ্বালা অনুভব করে। হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহ ও মানুষের কাছে ঘৃণিত। সমাজের লোকেরা হিংসুটে ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কেউ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না, এর অপকারিতা সীমাহীন। হিংসার অনিষ্টকারিতার কথা উল্লেখ পূর্বক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এরশাদ করেন- ‘তোমরা হিংসা থেকে নিবৃত্ত থাক। কেননা হিংসা নেক আমলকে খেয়ে ফেলে যেমনিভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।' (আৰু দাউদ : ৪২৫৭, বায়হাকী : ৬৩৩৩ ) একে অপরের প্রতি কোনো বিষয়ে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতে নেই । জীবন তো দয়াময় আল্লাহর দান, শারীরিক সৌন্দর্য, চারিত্রিক মাধুৰ্য, ধন- সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, সব কিছুই মহান আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত। এ জন্য আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা উচিত। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়েই খুশি থাকা বাঞ্ছনীয়। অপরের দিকে তাকিয়ে হিংসার আগুনে জ্বলে- পুড়ে লাভ কি?

ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় করা নিষেধ

সম্পদের অপচয় ও অপব্যয় একটি বদঅভ্যাস, অপছন্দনীয় এবং নিন্দনীয় কাজ। মানুষ যশ ও সুনাম-সুখ্যাতির জন্য সম্পদ কখনো অপব্যয় করে আবার গর্বের জন্য নিজের সম্পদ উজাড় করে দেয়। বিস্তর টাকা-পয়সা ও সম্পত্তি থাকলেই সে যে অপচয় করবে বা অপ্রয়োজনে খরচ করতে পারবে তা ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ এ সম্পত্তির প্রকৃত মালিক সে নয়, আসল মালিক আল্লাহ। সে শুধু এসবের তত্ত্বাবধানকারী মাত্র। যে সম্পদের মালিক সাধারণ জনগণ বা প্রতিষ্ঠান সে সম্পদ অকারণে নষ্ট করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে খরচের পরিমাণ বেশি করে দেখানো, ভুয়া ভাউচার দিয়ে বিল উঠানো, ভুয়া টিএ ডিএ বিল দেখানো, অপ্রয়োজনে বাসা বা অফিসের পানির কল, গ্যাসের লাইন, লাইট, ফ্যান, এসি বা কম্পিউটার চালু রাখাও অপচয় ও অপব্যয়ের মধ্যে গণ্য। আর এ সকল কাজে যারা সহযোগিতা করবে তারাও সমান অপরাধে অপরাধী। একজন খাঁটি মানুষ এ ধরনের কাজ করতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন- ‘তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।' (বনী ইসরাঈল, ১৭ : ২৬) ‘খাঁটি বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হলো যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না এবং তারা আছে এদুয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।' (ফুরকান, ২৫ : ৬৭) অপচয় ও অপব্যয়ের ফলে যে কেউ ভবিষ্যতে অর্থকষ্টে পড়তে পারে। ভবিষ্যতে যাতে কাউকে দুর্ভোগে পড়তে না হয় সে জন্য ইসলামের নির্দেশ হলো যে কোনো কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা আর হোক না তা ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এ সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- “যে ব্যক্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে সে কখনো অভাবগ্রস্ত হয় না।' (মুসনাদে আহমাদ : ৪০৪৮, তবারানি : ৯৯৭২)

ইসলামে ধোঁকা ও প্রতারণা করা নিষেধ

ধোঁকা ও প্রতারণার আরবী প্রতিশব্দ ‘আল-গাস্ত' যার অর্থ ঠকানো, ফাঁকি দেওয়া ও প্রবঞ্চনা। কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাউকে ঠকানোকে ধোঁকা ও প্রতারণা বলে। দৈনন্দিন জীবনে আমাদেরকে মানুষের সাথে পরস্পর লেনদেন ও বেচা-কেনা করতে হয়। লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয়ে কাউকে ঠকানো, পণ্যদ্রব্য বা প্রডাক্টের পরিচয় বা শর্ত গোপন করা, দু নম্বর পণ্যকে এক নম্বর বলা, পণ্যের পরিচয় দানে মিথ্যা উক্তি করা, ওযনে কম দেওয়া, চালাকি করে ওজনে বেশি নেওয়া, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো, কাউকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে যেকোন চুক্তি সম্পাদন করা, জালিয়াতি করা ধোঁকা ও প্রতারণা বলে অভিহিত। এ সমস্ত কাজ মিথ্যার শামিল। ইসলাম সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণকে সমর্থন করে না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ করো না এবং তোমরা জেনে-বুঝে সত্যকে গোপন করো না।' (বাকারা, ২ : 82 ) প্রতারণা একটি সামাজিক অপরাধ, এর ফলে মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, সামাজিক শান্তি শৃংখলা বিঘ্নিত হয়। যে মানুষের সাথে ধোঁকা ও প্রতারণা করে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। আমাদের নবী শুধু একদিন বাজারে শুকনো খাদ্যবস্তুর স্তূপের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় এর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খাদ্যবস্তু ভেজা পেলেন। তখন তিনি বললেন- হে খাদ্যের মালিক। এটি কি? জবাবে সে বললো, বৃষ্টির কারণে এরূপ হয়েছে। এ কথা শুনে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ধমক দিয়ে বললেন তুমি ভেজা খাদ্য উপরে রাখলে না কেন? যাতে লোকেরা তা দেখতে পেত? এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।' (মুসলিম ১৪৭) অথচ দৈনন্দিন জীবনে এরূপ কাজ আমাদের সামনে অহরহ ঘটছে। ওজনে কমবেশি দেওয়া ও নেওয়া এক প্রকার প্রতারণা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'মন্দ পরিণাম তাদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়। যারা লোকের নিকট হতে মেপে নেওয়ার সময় পুরোমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন অপরের জন্য মাপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।' (মুতফ্ফিফীন, ৮৩ : ১-৩)

পরিশেষে

সমাজের একশ্রেণীর মানুষ অপরকে বোকা বানিয়ে নিজে জিতাকে টেকনিক বলে প্রচার করে এবং এ রকম করা তেমন একটা দোষণীয় নয় বলে মনে করে। ইচ্ছাকৃতভাবে ঠকানোর উদ্দেশ্যে কাউকে বোকা বানানো শুধু নিষিদ্ধ নয় এমনকি খেলাচ্ছলে শিশু বা অবুঝ ব্যক্তির সাথে এরূপ কাজ করাও ইসলামে অপছন্দনীয় ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url