ইসলামে পর্দার বিধান

ইসলামে পর্দার বিধান

ইসলামে পর্দা বহন করা একটি বিষয় যা একটি পুরুষ এবং একটি মহিলা মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। পর্দা ইসলামে একটি প্রশংসিত বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরিচিত এবং বৈধ বিধান হিসাবে গণ্য করা হয়। কুরআন ও হাদিস বইগুলি ইসলামে পর্দার বিষয়ে প্রমাণ দিয়েছে। ইসলামে পর্দা প্রাথমিকভাবে একটি মহিলার উচ্চ গৌরব এবং সম্মান সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। কুরআনে বলা হয়, "মুসলিম মহিলাদের সম্মান কর, এবং তারা অপর মুসলিম মহিলাদের সাথে বিনিময় করে অপর অংশ নিশ্চিত কর। তাদের গোপন অংশ প্রদর্শন করতে না চাও।" (সুরা আল-নূর, আয়াত 31) পর্দা ইসলামে নারীর সুরক্ষা এবং তার জন্য সুরক্ষিত একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে।

 ইসলামে পর্দার বিধান

পর্দার হুকুম

পর্দার আরবী প্রতিশব্দ যার আভিধানিক অর্থ আবরণ, ঢাকনা, অন্তরাল ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ ঢেকে রাখার নামই হিযাব বা পর্দা। সাধারণভাবে পর্দা বলতে গায়রে মুহরিম পুরুষ বা গায়রে মুহরিম নারী থেকে নিজের মনমানসিকতা, চোখ, কান, জিহ্বা ইত্যাদিকে হিফাজত করে যৌন জীবনকে পবিত্র রাখাকে বুঝায় । পর্দা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীল, লজ্জাশীল, (মানুষের পাপ) আড়ালকারী। তিনি লজ্জাশীলতা ও পর্দাকে পছন্দ করেন।' (নাসায়ী : ৪০৩, আবু দাউদ : ৩৪৯৭) পর্দা ইসলামী শরীয়তের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পুরুষ ও নারী সকলের জন্য পর্দার বিধানকে ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের উদ্দেশে বলেন- ‘মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন (পরনারী থেকে) তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।' (নূর, ২৪ : ৩০)

নারীদের পর্দা

অনুরূপ নারীদের উদ্দেশে পরবর্তী আয়াতেই বলা হয়েছে- 'মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন (পরপুরুষ থেকে) তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, তারা যেন যা সাধারণত অনাবৃত থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে, তাদের গলা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।' (নূর, ২৪ : ৩১) নারীরা যাদের সামনে যেতে এবং দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবে তাদের পরিচয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা-রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের আভরণ প্রকাশ না করে।' (নূর, ২৪ : ৩১)

উপর্যুক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে যাদের সাথে নারীগণ দেখা (সতর গোপন করে সাধারণ আভরণ প্রদর্শন) করতে পারবে তারা হলেন- ১. স্বামী (যার কাছে কোনো পর্দার প্রয়োজন হয় না)

২. পিতা, সৎপিতা, দুধপিতা, দাদা, নানা ও তাদের ঊর্ধ্বপিতাগণ ৩. পুত্র, সৎপুত্র, দুধপুত্র, পুত্রদের পুত্র ও নাতিগণ ৪. আপন, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রেয় ও দুধ ভাই ৫. আপন, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় চাচা ৬. আপন, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় মামা ৭. ভাতিজা, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভাইয়ের পুত্রগণ ৮. ভাগিনা, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোনের পুত্রগণ ৯. আপন শশুর ১০. মেয়ের স্বামী বা জামাতা ও নাতিগণের স্বামী ১১. ঐ সমস্ত বালক যাদের কাছে এখনো মেয়েদের বিষয় স্পষ্ট হয়নি ১২. ঐ সমস্ত পুরুষ, মহিলাদের প্রতি যার কোনো আকর্ষণ নেই ।

পুরুষদের পর্দা

পুরুষদের জন্য যাদেরকে বিয়ে করা হারাম এবং যাদের সাথে দেখা করা জায়েয তাদের পরিচয় উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মাতা, কন্যা, ভগ্নি, ফুফু, খালা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভাগিনেয়ী, দুগ্ধ-মাতা, দুগ্ধ-ভগিনী, শাশুড়ী, ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সঙ্গে সংগত হয়েছে তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তবে যদি তাদের সঙ্গে সংগত না হয়ে থাক, তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ নাই এবং তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দুই ভগ্নীকে একত্র করা, পূর্বে যা হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (নিসা, ৪: 23 ) পর্দা হলো উৎপীড়নকারীর রক্তচক্ষুর হাত থেকে নিজের মান-সম্ভ্রম ও সর্বাঙ্গ রক্ষা করা। নারীর চলাফেরা কেমন হবে এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মু'মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (নূর, ২৪ : ৩১) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- 'যে মহিলা সুগন্ধি লাগিয়ে এই উদ্দেশ্যে লোকের মধ্যে গমন করে যে, তারা তার সুগন্ধির ঘ্রাণ পাবে, সে ব্যভিচারিণী।' (নাসায়ী : ৫০৩৬, মুসনাদে আহমাদ : ১৮৮৭৯)

নারীদেরকে উত্ত্যক্ত করা আমাদের সমাজে একটি ভয়াবহ সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরণকল্পে পর্দার হুকুম দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে করে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (আহযাব, ৩৩ : ৫৯) উম্মাহাতুল মুমিনীন বা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র সহধর্মিণীগণ মুসলিম নারীদের জন্য আদর্শ ও অনুসরণীয় । অতএব পর্দার বিষয়ে তাঁদের উপর যে হুকুম তা সকল মুসলিম নারীর জন্যও প্রযোজ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।' (আহযাব, ৩৩ : ৩২) একজন পুরুষের জন্য গায়রে মুহরিম মহিলার প্রতি স্বাভাবিক দৃষ্টিপাতের পর পুনরায় দৃষ্টিপাত শয়তানের কাজ উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন- 'পর নারীর উপর দৃষ্টি পড়ে গেলে তা ফিরিয়ে নেবে এবং দ্বিতীয়বার তার প্রতি আর দৃষ্টিপাত করবে না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমার আর দ্বিতীয়টি তোমার নয় (শয়তানের)।' (আবু দাউদ : ১৮৩৭, তিরমিযি : ২901) গায়রে মুহরিম পুরুষ ও নারীর জন্য তৃতীয় ব্যক্তি ছাড়া নির্জনে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)সতর্ক করে বলেন- ‘গায়রে মুহরিম নারী ও পুরুষ তৃতীয় ব্যক্তি ছাড়া নির্জনে সাক্ষাৎ করবে না কেননা সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি থাকে শয়তান।' (তিরমিযি : ১০৯১) পর্দা শুধু নারী-পুরুষ একে অপরের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং পুরুষে পুরুষে ও নারীতে নারীতে পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- “কোনো পুরুষ কোনো পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোনো নারী অন্য কোনো নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। দুজন পুরুষ একত্রে একই কাপড়ে ঘুমাবে না। তেমনি দুজন মহিলা একত্রে একই বস্ত্রের মধ্যে জড়াজড়ি করে ঘুমাবে না।' (মুসলিম : ৫১২, তিরমিযি : ২৭১৭)

উপসংহার

হিজাব বা পর্দা বলতে শুধু পোশাক পরে আবৃত হওয়াকেই বুঝায় না বরং মানুষের আচার-আচরণ, ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিপ্রায়কেও বুঝায়। পোশাকের পাশাপাশি চোখ, মন, চিন্তা-চেতনা ও হৃদয় পবিত্র রাখার মাধ্যমে হিজাব বা পর্দার বিধান মানতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url