ইসলামী দৃষ্টিকোনে জ্ঞান অর্জন

ইসলামী দৃষ্টিকোনে জ্ঞান অর্জন

ইসলামিক দৃষ্টিকোণে জ্ঞান অর্জন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাথমিক। ইসলামে জ্ঞান অর্জন একটি দায়িত্ব এবং ইসলামী সমাজে একজন মুসলিম মানুষের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। একজন মুসলিম মানুষ কখনওই স্বয়ংক্রিয় না হয়ে আল-কুরআন এবং সুন্নাহের উপর ভিত্তি করে জ্ঞান অর্জন করতে হয়।ইসলামে জ্ঞান অর্জনের একটি প্রধান উপায় হল তালিম বা শিক্ষা প্রণালী। তালিমের ব্যবস্থা আল-কুরআন ও সুন্নাহের উপর নির্ভর করে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আল-কুরআন একটি দীন এবং জীবনের পরামর্শপূর্ণ গ্রন্থ, এবং এটি প্রত্যেক মুসলিমের বাক্য ও কার্যের উপর প্রভাব ফেলে থাকে।
ইসলামী দৃষ্টিকোনে জ্ঞান অর্জন

ইসলামী দৃষ্টিকোনে জ্ঞান অর্জন

ইসলামে জ্ঞানার্জন বা জ্ঞানচর্চার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্ঞানকে আলোর সাথে তুলনা করেছেন। আলো যেমন অন্ধকার দূরীভূত করে তেমনি জ্ঞান অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূর করে সত্য ও সুন্দর কল্যাণের পথকে আলোকিত করে। জ্ঞান ছাড়া কোনো কর্ম সাধন করা যেমন সম্ভব হয় না তেমনি জ্ঞান ছাড়া কর্মের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়ে থাকে । মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার প্রথম নির্দেশ জ্ঞানসম্পর্কিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড হতে। পড়, তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে জ্ঞান শিখিয়েছেন, যা সে জানতো না।' (আলাক, ৯৬ : ১-৫) জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।' (ইবনে মাজাহ : ২২০, তবারানি : ১০২৮৬, বায়হাকী : ১৬১২)

জ্ঞানের উৎস

জ্ঞানের একমাত্র নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য উৎস হলো ওহী । আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে এ জ্ঞান বিতরণ করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও মহানবী প্রদত্ত হাদীস বা সুন্নাহ ওহীর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।' (রহমান, ৫৫ : ১- 8)ওহী ছাড়াও ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, জ্ঞান-গবেষণা, ইলহাম প্রভৃতি উৎস হতেও জ্ঞান আহৃত হতে পারে তবে এ সকল উৎস হতে প্রাপ্ত জ্ঞান পুরোপুরি নির্ভুল নাও হতে পারে । দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ের জ্ঞান কুরআন-সুন্নায় বিদ্যমান। যে কোনো জ্ঞান অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে ওহীর নির্দেশকে সামনে রাখলে সে বিষয়ে নির্ভুল জ্ঞান অর্জন করা সহজ বিধায় একজন মানুষের জন্য ওহীর জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কেননা, এর দ্বারা ব্যক্তির মাঝে আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা বদ্ধমূল হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে।' (ফাতির, ৩৫ : ২৮) যাচাই-বাছাই করে আল্লাহপ্রদত্ত বিধি-বিধানের আলোকে সঠিক আমল করতে পারে বিধায় একজন আলেমের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'একজন জ্ঞানী ব্যক্তি শয়তানের বিরুদ্ধে এক হাজার আবেদের চেয়েও উত্তম।' (ইবনে মাজাহ : ২১৮, তবারানি : ১০৯৩৬, বায়হাকী : ১৬৭৪)

কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা ফরয?

ফরয মানে অবশ্য পালনীয়, যা পালন না করলে আল্লাহ শাস্তি দেবেন। নবী-রাসূল ব্যতীত কোনো মানুষের পক্ষে ওহী অথবা পার্থিব কোনো জ্ঞানই পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। যেহেতু পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় সেহেতু কতটুকু জ্ঞান আহরণ করা ফরয এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। বিষয়টি পরিষ্কার না হলে মুসলিম হিসেবে সঠিকভাবে জীবন যাপন করা একেবারেই অসম্ভব। একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে এ প্রশ্নের সঠিক জওয়াব সহজেই বুঝে আসবে। যার উপর হজ-যাকাত ফরয নয়, তার ঐ বিষয়ে জানা আবশ্যক নয়। যার উপর যাকাত ফরয তাকে এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হলে ওহীর ইল্ম থেকে জানতে হবে যে, কোন কোন সম্পদের কী পরিমাণের মালিক হলে যাকাত ফরয হয় এবং এর হিসাব কিভাবে করতে হয়, কত মালের কত পরিমাণ যাকাত আদায় করতে হয় এবং কোন কোন খাতে যাকাত খরচ করলে ফরযটি সঠিকভাবে আদায় হবে। যার উপর যাকাত ফরয নয় তার এ সব বিষয়ে জানা জরুরি নয় । তেমনিভাবে, একজন যুবক ও একজন যুবতীর মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তাদেরকে মুসলিম স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আল্লাহ তায়ালার হুকুম ও রাসূলের সুন্নাহ মেনে দাম্পত্য জীবন যাপন করার প্রয়োজনে যতটুকু ওহীর জ্ঞান প্রয়োজন তা অর্জন করা ফরয। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে যা জানা ফরয ছিল না। আর যদি তারা তা অর্জন না করে তাহলে তারা হয়তো কাফির দম্পতির মতোই জীবন যাপন করবে । ডাক্তারি পেশা গ্রহণ করলে তাকে ডাক্তারি বিদ্যার জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে রোগীদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারা যদি চিকিৎসা বিদ্যা ভালোভাবে আয়ত্ত না করে, যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় সে বিষয়েও ব্যবস্থাপত্র লিখে রোগীর সাথে প্রতারণা করে তাহলে তার আয় হালাল হবে না। তাই তার আয় হালাল করার প্রয়োজনেই তাকে ঐ বিদ্যা যথাযথভাবে অর্জন করতে হবে। অনুরূপ যে কোনো পেশার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন না করে সেবা প্রদান করলে তার আয়-উপার্জনও হালাল হবে না । দুনিয়াবি কার্য সম্পাদনে বা আখেরাতের মুক্তির নিমিত্তে যার উপর যে দায়িত্ব পালন করা ফরয সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের প্রয়োজনে জাগতিক ও ওহীর যতটুকু জ্ঞান জানা জরুরি ততটুকু জ্ঞান অর্জনই ফরয।

জাগতিক জ্ঞানের শরীয়তের মর্যাদা

ইসলাম ওহীভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞানের ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। একটি জনপদের জন্য যেমন ধর্মীয় আলেম প্ৰয়োজন তেমনি কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, বিচারক, প্রশাসক, বীমাবিদ, ব্যাংকার, হিসাববিদ, নিরীক্ষক প্রভৃতি পেশাদারদেরও প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এ সকল জ্ঞানের শরয়ী মর্যাদা কি? এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিম্নোক্ত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- ‘হালাল রুজি সন্ধান করা ফরযের পরেও একটি ফরয।' (বায়হাকী ৮৪৮২) উপর্যুক্ত হাদীসের আলোকে হালাল রিযিক সন্ধান করা ফরয, তাই পার্থিব জীবনে জীবিকা নির্বাহের যে সকল বৈধ পেশা রয়েছে সে সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করাও প্রকারান্তরে ফরয। এ দৃষ্টিকোণ থেকে যিনি যে পেশায় রয়েছেন তার সে পেশা সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করাও অপরিহার্য। জাগতিক ও ওহীভিত্তিক জ্ঞান একে অপরের পরিপূরক। তবে জাগতিক জ্ঞানকে আল্লাহ তায়ালার হুকুম ও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর তরিকা মোতাবেক পরিচালনা করার জন্য যতটুকু ওহীর জ্ঞান প্রয়োজন তা অর্জন করাও অত্যাবশ্যক।

পেশাভিত্তিক জ্ঞানের শরীয়তের মর্যাদা

কর্ম বা পেশার ক্ষেত্রে জ্ঞানই চালিকাশক্তি। ব্যক্তি যে পেশায় নিয়োজিত সে সম্পর্কে যদি পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকে তাহলে তিনি সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে না। এতে করে কর্মরত প্রতিষ্ঠান, সেবা গ্রহণকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেভাবে সাঁতার না জানা ব্যক্তি নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য পানিতে নেমে ডুবে মারা যাবে। কর্মক্ষেত্রে করণীয় বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক নতুবা সে বিষয়ে তার অনুসরণ করা উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে বলেন- ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না।' (বনী ইসরাঈল, ১৭ : ৩৬) আল্লাহ তায়ালা দক্ষতার সাথে কাজ করাকে পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, যে তার কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে।' (বায়হাকী : ৫০৮০, তবারানি : ৯০৯)

যে সকল জ্ঞান অর্জন করা যাবে না

কুরআন ও হাদীসে যে সব কর্মের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং যে সব জ্ঞান মানুষকে কুফর ও শিরকের দিকে নিয়ে যায় তা অর্জন বা চর্চা করা হারাম। আল্লাহ তায়ালার হুকুমতের বিপরীত জ্ঞান যেমন- সুদ, যেনা-ব্যভিচার, অশ্লীলতা, যাদু-টোনা, সম্পদ আত্মসাৎ, গণক, প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষ বিদ্যার কিছু অংশ শিখলো সে মূলত যাদু বিদ্যারই কিছু অংশ শিখলো। এ যত বাড়বে যাদু বিদ্যাও তত বাড়বে।' (আবু দাউদ : ৩৪০৬) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেন-‘যে ব্যক্তি গিরা লাগায় অতঃপর তাতে ফুঁকক দেয় সে মূলত যাদু করে। আর যে ব্যক্তি যাদু করে সে মূলত শিরক করে আর যে ব্যক্তি কোনো জিনিস (তাবিজ-কবজ) লটকায় তাকে ঐ জিনিসের দিকেই সোপর্দ করা হয়।' (নাসাঈ : ৪০১১, তবারানি : ৪০8 ) ইসলাম বিরোধী যে কোনো দর্শন বা সাহিত্য, কুফরি সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করাও হারাম। একইভাবে অকল্যাণকর ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন বা চর্চা করাও নিষেধ । যে জ্ঞান অর্জনের মধ্যে কোনো উপকারিতা নেই সে জ্ঞান অর্জনেরও কোনো প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং উপকারিতা নেই এমন জ্ঞান অর্জন করা থেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেন-‘হে আল্লাহ! আমি ঐ জ্ঞান অর্জন থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা উপকারী নয়।' (মুসলিম : ৪৮৯৯, নাসাঈ : ৫৩৭৫)

পরিশেষে

কুরআন ও হাদীসে যে সব কর্মের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং যে সব জ্ঞান মানুষকে কুফর ও শিরকের দিকে নিয়ে যায় তা অর্জন বা চর্চা করা হারাম। ইসলাম বিরোধী যে কোনো দর্শন বা সাহিত্য, কুফরি সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করাও হারাম।যে জ্ঞান অর্জনের মধ্যে কোনো উপকারিতা নেই সে জ্ঞান অর্জনেরও কোনো প্রয়োজন নেই।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url