জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি ও ফজিলত
জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি ও ফজিলত
জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি ও গুরুত্ব
জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা থাকতে হবে এবং তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ও প্রাজ্ঞজনদের নিকট থেকে চেয়ে নিতে হবে। হযরত মুসা হযরত খিজির (আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লাম) থেকে জ্ঞান চেয়ে নিয়েছেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি খিজির (আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লাম) এর সফর সঙ্গীও হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে সে ঘটনা উল্লেখ করে বলেন-‘মূসা তাকে বললো, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে তা হতে আমাকে শিক্ষা দিবেন, এই শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করবো কি?' (কাহাফ, ১৮ : ৬৬) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যাকে ইচ্ছা জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে থাকেন । তাই প্রতিনিয়ত তাঁর কাছেই আমাদের জ্ঞানের নিয়ামত চাওয়া উচিত। পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত একটি দোয়াও তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন- ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।' (তহা, ২০ : ১১৪ )অজ্ঞতাবশত জনৈক ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় অপবিত্র হলে তায়াম্মুমের স্থলে গোসল করে ফেললে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- “অবশ্যই যারা জানে না তারা প্রশ্ন করবে, কেননা অজ্ঞতার প্রতিষেধক হচ্ছে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া, নিশ্চয়ই এটা তার জন্য যথেষ্ট।' (আবু দাউদ : ২৮৪, দারে কুতনী : ৯৮৮ )
ইলম / জ্ঞান যাচাই করে নিতে হবে
বিরুদ্ধবাদীরা ইসলাম তথা কুরআন ও হাদীসের বিকৃত তথ্য ও ভুল ব্যাখ্যা প্রচারে ব্যাপকভাবে লিপ্ত থাকায় জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে নির্ভরযোগ্য স্থান হতে তা আহরণ করতে হবে। প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে সিরিন লি বলেন-“নিশ্চয়ই এই ইলম দীনের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তোমরা কার নিকট থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ করছো তা ভালো করে দেখে নাও।' (মুসলিম মুকাদ্দামা) বিরুদ্ধবাদীরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ায়, সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করে। মুসলিম জাতিকে ক্ষতি হতে রক্ষার জন্য বিরুদ্ধবাদীদের প্রদানকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে বলেন- 'হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বস এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।' (হুজরাত, ৪৯ : ৬) কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহ তায়ালা আলেমদেরকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমে দীনকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন। এরপর মূর্খ লোকেরা নিজের মনগড়া মতামত প্রদান করবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-‘নিশ্চই আল্লাহ ইলমে দীনকে মানুষ থেকে টেনে উঠিয়ে নেবেন না। বরং তিনি আলেমদেরকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নেবেন। এমন কি যখন কোনো আলেমকে বাকি রাখবেন না তখন মানুষ মূর্খ লোকদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তাদেরকে (দীনের ব্যাপারে) জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তারা ইলম ছাড়া ফাতওয়া দিবে। এর ফলে তারাও পথভ্রষ্ট হবে এবং মানুষকেও পথভ্রষ্ট করবে।' (বুখারী : ৯৮, মুসলিম : ৪৮২৮ )
কুরআন-সুন্নার ইলম / জ্ঞান অর্জনের মর্যাদা
বান্দা যতক্ষণ জ্ঞান আহরণে লিপ্ত থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহ তায়ালার পথে থাকে অর্থাৎ সে সেই সময় আল্লাহ তায়ালার দীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে লিপ্ত রাখে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে বের হয়, সে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই থাকে।' (তিরমিযি : ২৫৭১, তবারানি : ৩৮১) ব্যক্তি তার অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে যাছাই-বাছাই করে যথার্থ আমল করতে পারে বিধায় আল্লাহ তায়ালা তার মর্যাদাকে আরো উন্নত করেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে- 'তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।' (মুজাদালা, ৫৮ : 11 )
ইলম অর্জনকারী / জ্ঞানীরা নবীদের উত্তরসূরী
আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণকে স্বীয় উম্মতের পথনির্দেশ ও দীন শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রেরণ করেন। তাদের অবর্তমানে এ দায়িত্ব পালন করে আলেমগণ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্ঞান অন্বেষণকারীর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন- 'যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে পথ চলে আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা তাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করেন। জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য ফেরেশতাগণও তাদের পাখা নামিয়ে দেয়। আসমানে যা কিছু আছে এবং জমিনে যা কিছু আছে এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ইস্তিগফার করে। একজন আবিদের উপর একজন জ্ঞানীর ফযীলত সেরূপ যেরূপ নক্ষত্রপুঞ্জের উপর চাঁদের ফযীলত। জ্ঞানীরা হলেন নবীগণের উত্তরাধিকারী । নবীগণ তো মিরাছ হিসাবে টাকা-পয়সা বা ধন-দৌলত রেখে যান না। তাঁরা মিরাছ হিসেবে রেখে যান জ্ঞান, যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে তো পূর্ণ হিসাব লাভ করলো।' (তিরমিযি : ২৬০৬, আবু দাউদ : ৩১৫৭)
ইবাদত অপেক্ষা দীনি জ্ঞান অর্জন উত্তম
সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার চেয়ে রাতের কিছু সময় জ্ঞান আহরণ করা শ্রেয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন- আর‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানের পারস্পরিক আলোচনা করা সারা রাত জেগে ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম।' (সুনানে দারেমী : ২৭০ ) জ্ঞানীরা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহপ্রাপ্ত যে ব্যক্তি প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারে বা আল্লাহ্ যাকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দেন তাকে তিনি প্রভূত কল্যাণ দান করেন। রাসূলুল্লাহ-(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে কল্যাণ দান করেন, তাকে তিনি দীন সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান দান করেন।' (তিরমিযি : ২৫৬৯, ইবনে মাজাহ : ২১৬)
ইলম / জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য
কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সকল জাগতিক ও ওহীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পার্থিব সুনাম-সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করা হলে তা আখেরাতের জন্য হবে নিষ্ফল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন ‘যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইলমকে দুনিয়াবি লাভের আশায় অর্জন করলো সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।' (আবু দাউদ ৩১৭৯) মুসলিম শরিফের ৩৫২৭ নং হাদীসে কিয়ামতের একটি দৃশ্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে- কিয়ামতের দিন বিচারের জন্য একজন আলেমকে আনা হবে, যে নিজে ইলম শিখেছে, কুরআন পড়েছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতগুলো স্মরণ করানো হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, এর প্রতিদানে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার জন্য ইলম শিখেছি, কুরআন পড়েছি এবং অপরকে শিখিয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; বরং তুমি তো এই জন্য ইলম শিখেছ যাতে লোকে তোমাকে আলেম বলে। তা তো বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে । জ্ঞান অর্জন যদি হয় দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তাহলে তা ক্ষতিকর ও লোকসান ছাড়া আর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মনীষী ইমাম গায্যালি (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর বিদায়াতুল হিদায়াহ গ্রন্থে বলেছেন- ‘ইলম ও জ্ঞানচর্চার দ্বারা যদি তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আত্মগৌরব ও বড়াই-অহংকার করা, সমকালীন লোকদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা, আপন প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্ববাসীর নিকট প্রিয়পাত্র অথবা ভক্তিভাজন হওয়া, পার্থিব গৌরব অর্জন করা এবং রকমারি ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করা, তাহলে জেনে রাখো- এই জ্ঞান অর্জনের দ্বারা তুমি তোমার দীন ও ঈমান ধ্বংস করছ, স্বীয় মূল্যবান জীবন বিনষ্ট করছ। নশ্বর এই পৃথিবীর বিনিময়ে আখেরাতের অনন্ত জীবনকে বিক্রয় করে দিচ্ছ। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত গর্হিত ও ক্ষতিকর কাজ। এই ব্যবসায় তোমার বৃহৎ লোকসান ছাড়া লাভের কিছু অবশিষ্ট থাকছে না।
পরিশেষে
সকল সৃষ্টির মধ্যে বিশেষভাবে মানুষকেই আল্লাহ তায়ালা ইলম/জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দান করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে তেমনি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি- অসন্তুষ্টি এবং আখেরাতের সফলতা-ব্যর্থতার জ্ঞানও ধারণ করতে পারে । মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এর প্রয়োজনীয়তা বা যোগ্যতা নেই। আর সকল জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি।
Read More:ইসলামী দৃষ্টিকোনে জ্ঞান অর্জন