নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ফজিলত

নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ফজিলত

নিয়ত হল কোন কাজ বা আমলের উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে এর কর্তব্য বা প্রত্যাশা করা। এটি আমলের প্রথম আসর। নিয়ত ব্যক্তির দৃষ্টিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটি আমল যদি ভাল নিয়ত সহ করা না হয় তবে তা কখনওই কাম্য ফল দেয় না। একটি আমল যদি নিয়ত সহ করা হয় তবে তা বিশুদ্ধ হয়ে ও ফজিলত প্রাপ্ত হয়।একটি বিশুদ্ধ নিয়ত হল যে নিয়তটি খুব স্পষ্ট এবং একটি ইসলামিক আমল হিসাবে করা হয়েছে। নিয়ত করার সময় হলে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে পারে এবং তার প্রত্যাশার সাথে কাজ করতে পারে। এছাড়াও নিয়ত পরিষ্কার হওয়া উচিত যে এটি করা উচিত এবং ইসলামের আদর্শ অনুসরণ করা উচিত।একটি বিশুদ্ধ নিয়ত সম্পর্কে ইসলাম ধর্মে অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ফজিলত

নিয়তের বিশুদ্ধতা

 নিয়ত শব্দটি আরবী, অর্থ ইচ্ছা, সংকল্প, ও অভিপ্রায় করা ইত্যাদি । কোনো কাজ করার অভিপ্রায়কেই নিয়ত বলা হয়। মুমিনের সকল কাজ হতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর সন্তুষ্টির ইচ্ছা নিয়ে যে কাজ করা হয় তাই বিশুদ্ধ নিয়ত । নিয়ত ও কাজের সমন্বয়কে চার ভাগে ভাগ করা যায়।যেমন- ১. নিয়তও ভালো কাজও ভালো। যেমন, কেউ সালাত আদায় করলো আল্লাহকে রাজি করার উদ্দেশ্যে। ২. নিয়তও খারাপ কাজও খারাপ। যেমন, কেউ ডাকাতি করলো মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। ৩. নিয়ত খারাপ কিন্তু কাজ ভালো। যেমন, কাউকে দান করলো দানবীর খ্যাতি পাবার জন্য। ৪. নিয়ত ভালো কিন্তু কাজ খারাপ। যেমন, কেউ চুরি করলো দান করার জন্য। উপর্যুক্ত চার ভাগের মধ্যে শুধু প্রথম ভাগটিই বিশুদ্ধ

সবকিছু নির্ভর করে নিয়তের উপর

কাজের প্রতিদান পাওয়া বা না পাওয়া, আমল বিশুদ্ধ হওয়া বা না হওয়া এ সব কিছুই নিয়তের উপর নির্ভর করে। নিয়ত ভালো হলে কাজের প্রতিফল অনেকগুণ বেশি পাওয়া যাবে আর নিয়ত ভালো না হলে তার ফল বা প্রতিদান পাওয়া যাবে না। ঈমানের পরিচিতির মধ্যে বান্দার অন্তরের নিয়ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অন্তরের নিয়ত দ্বারাই বান্দার ঈমান ও কুফরির মাঝে পার্থক্য করা হয়। আল্লাহকে সিজদাকারী আর মূর্তিকে সিজদাকারী উভয়েই একই কাজ সম্পাদন করছে, কিন্তু অন্তরের নিয়তের ভিন্নতার কারণে একজন হয় ঈমানদার আর অন্যজন হয় কাফির। নিয়ত হলো রূহ স্বরূপ আর আমল হলো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোনো আদেশ দেওয়া হয় নাই যে, তারা শুধু আল্লাহর জন্য দীনকে খালিস করে তাঁরই ইবাদত করবে।' (বাইয়্যিনাহ, ৯৮ : ৫) এ সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- ‘সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করবে তাঁর হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকেই হবে। আর যে ব্যক্তি হিজরত করবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তাহলে তাঁর হিজরত হবে সেই দিকে যে দিকে সে হিজরত করেছে।' (বুখারী : ০১, মুসলিম : ৩৫৩০, নাসাঈ ৩৩৮৩)

বিশুদ্ধ নিয়তের প্রয়োজনীয়তা

বিশুদ্ধ নিয়ত না থাকলে ভালো কাজ করলেও তার পরিণাম জাহান্নাম । মানুষ যখন কোনো কাজ করে তখন সে মনে মনে একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে সে কাজের প্রতি অগ্রসর হয়। এটা মানুষের জন্মগত স্বভাব। এ উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ তাঁর কাজের ফলাফল আল্লাহ তায়ালার কাছে পাবে। যেমন ‘হিজরত' বড় পুণ্যের কাজ এবং তা কঠিনও। কারণ এতে আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধন-দৌলত, ঘরবাড়ি সব কিছুই পরিত্যাগ করতে হয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে হিজরতের অনেক সাওয়াব ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি এ কঠিন আমলের জন্য প্রস্তত হবে সে নিশ্চয়ই এ উদ্দেশ্য নিয়ে তা সম্পন্ন করবে। যদি তার উদ্দেশ্য হয় এ মহান ত্যাগের দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সন্তুষ্ট করা, তবে সে তার এ কাজের ফল তাঁর উদ্দেশ্য ও নিয়ত অনুসারে পাবে। আল্লাহ তায়ালার কাছে বিশেষ মর্যাদা পাবে এবং এর ফলে তার এ দেশত্যাগ সার্থক হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে হিজরত করবে যেমন সুখ্যাতি লাভ করা, টাকা উপার্জন করা, কোনো নারীকে বিয়ে করা বা এ জাতীয় কোনো হীনস্বার্থ হাসিল করা, সে কোনোরূপ সাওয়াবের অধিকারী হবে না। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন-‘সর্বপ্রথম বিচারের জন্য কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে যে ব্যক্তি শহীদ হয়েছিল। সে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার যে সব নিয়ামত ভোগ করেছিল তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে এবং তা সে স্বীকার করবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে তুমি এ সব নিয়ামতের বিনিময়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, হে আমার রব! আমি তো তোমার দীনের জন্য জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি জিহাদ করেছিলে বীরপুরুষ বলে অভিহিত হওয়ার জন্য। তা তো তোমাকে বলা হয়েছে, তারপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে যে ইলম শিখেছে এবং অপরকে শিখিয়েছে ও কুরআন পড়েছে। তাকেও তার নেয়ামতের কথা স্মরণ করতে দেওয়া হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। সে বলবে, হে আমার রব! আমি ইলম শিখেছি ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছি। আর আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ বরং তোমার উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা তোমাকে আলিম বলবে এবং কুরআন পড়েছ যাতে লোকেরা বলে সে একজন ক্বারী, তা তো বলা হয়েছে। এরপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে আল্লাহর হুকুমে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে যাকে আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রকার ধন-সম্পদ থেকে প্রচুর পরিমাণ দিয়েছেন তাকেও তার নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। তারপর আল্লাহ বলবেন, এ ব্যাপারে তুমি কি আমল করেছো? সে বলবে, হে আমার রব! যেখানে দান করলে আপনি সন্তুষ্ট, আমি সে সব স্থানে দান খয়রাত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো, তুমি তো এই জন্য তা করেছো যাতে তোমাকে দাতা বলা হয়, তা তো বলা হয়েছে। আল্লাহর হুকুমে তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।' (মুসলিম: ৩৫২৭ সুনানে কুবরা লিন নাসাঈ : ৮০৮৩) অন্য হাদীসে পাওয়া যায়-‘বান্দা তাঁর সালাত শেষ করে তখন তাঁর আমলনামায় এক দশমাংশ, এক নবমাংশ, এক অষ্টমাংশ, এক সপ্তমাংশ, এক ষষ্ঠাংশ, এক পঞ্চমাংশ, এক চতুর্থাংশ, এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক সাওয়াব লেখা হয়।' (আবু দাউদ : ৬৭৫)

ইবাদত ও অভ্যাসগত কাজের পার্থক্য সৃষ্টি হয় নিয়তের কারণে

নিয়তের কারণেই ইবাদত ও অভ্যাসগত কাজের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যেমন নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের খোরপোশের ব্যবস্থা করা মানুষের স্বভাবগত অভ্যাস। কিন্তু কেউ যদি তা আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাতের অনুসরণের উদ্দেশ্যে করে তাহলে তার এ কাজটি ইবাদতে পরিণত হবে এবং সে ব্যক্তি প্রতিদানের অধিকারী হবে। নিয়ত যদি ভালো হয় তাহলে কখনো কাজ করতে না পারলেও শুধু নিয়তের কারণে সাওয়াবের ভাগী হয় । এ প্রসঙ্গে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- 'যে ব্যক্তি ঘুমাতে আসে এবং নিয়ত করে যে, সে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ পড়বে। কিন্তু তার চোখ লেগে যায় এবং ফজর পর্যন্ত সে আর জাগ্রত হয় না। তাহলে সে যা নিয়ত করেছিল তার পরিপূর্ণ সাওয়াব তাকে দেওয়া হয় আর তার ঘুম হবে সাদাকাস্বরূপ।' (আবু দাউদ : ১১১৯, নাসাঈ : ১৭৬৩) বিশুদ্ধ নিয়তকারী মুখলেছদের প্রশংসা করেন আল্লাহ তায়ালা-‘আর স্মরণ কর এই কিতাবে মুসাকে। নিশ্চয়ই সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে ছিল রাসূল, নবী।' (মারইয়াম, ১৯ : ৫১)

নিয়তের ফজিলত ও গুরুত্ব

যদি নিয়ত বিশুদ্ধ হয় তাহলে আমল স্বল্প হলেও মুক্তি পাওয়া যাবে । যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন-'তোমার দীনকে বিশুদ্ধ কর, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।' (মুসতাদরাক : ৭৯৫৫) বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে কাজ করলে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হক এর শাফায়াত লাভ হবে। যেমন হাদীসে পাওয়া যায়-‘কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত দ্বারা সর্বাধিক সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি হবে যে খালেস অন্তর থেকে বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।' (বুখারী : ৯৭, মুসনাদে আহমাদ : ৮৫03)

সার সংক্ষেপ

উপর্যুক্ত হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, কাজের আগে উদ্দেশ্য স্থির করা এবং গাফলতির সাথে লক্ষ্যহীন অবস্থায় কোনো কাজ না করা। ফলে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে পার্থিব উদ্দেশ্য কোনো আমল করা হয় তাহলে এতে আল্লাহ কাছ থেকে কোনো বিনিময় পাওয়া যাবে না বরং শাস্তি হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url